ইতিহাস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সালাহ্উদ্দীন আহ্মদের প্রধান আগ্রহ বাঙালির সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশধারার সূত্র অন্বেষণ ও মানচিত্র তৈরি। উনিশ শতকে তাঁর আইকন রামমোহন রায়, বিশ শতকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভারতীয় মুসলমানদের অনগ্রসরতার কারণও তিনি বিশ্লেষণ করেছেন এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রগতিশীল ধারাকে শনাক্ত করেছেন। তাঁর প্রত্যয় : বাঙালি ধর্মীয়-বিবেচনায় বিভক্ত হলেও মূলত সমন্বয়বাদী চেতনার মানুষ। তাঁদের জীবনধারায়, আচরণে লৌকিক বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণা প্রবল, ফলে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এক মোহনায় মিলতে পেরেছে। নানা বিভেদ ও বৈষম্য সত্ত্বেও বাঙালির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অখণ্ডতায় আস্থাশীল ছিলেন তিনি। বিশ শতকের ষাটের দশক থেকে পূর্ব বাংলায় জাতীয়তাবাদী উত্থানও তাঁর ইতিহাস-গবেষণায় গুরুত্ব পেয়েছে। তাঁর বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রকৃত বিকাশের জন্য অপরিহার্য হচ্ছে গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার ধর্ম এবং রাজনীতি উভয়কেই কলঙ্কিত করছেÑএ কথা বারবার বলেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেনÑমানবতার উপরে আর কোনো আদর্শ স্থান পেতে পারে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে খাটো করে দেখার যেকোনো প্রয়াসের প্রতিবাদ করেছেন তিনি। সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ যেকোনো সাম্প্রতিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে ইতিহাসের বৃহত্তর পটভূমির ক্যানভাসে স্থাপন করে বিচার-বিশ্লেষণ করতেন। ব্যক্তির অভিজ্ঞতার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে তার থেকে সমসাময়িক ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহের বিবরণ তৈরি করা মৌখিক ইতিহাস চর্চার এ ধারাটিও বাংলাদেশে প্রবর্তন করেছিলেন সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ। ইতিহাস-পরিষদ, বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি, এশিয়াটিক সোসাইটি, জাতীয় জাদুঘর, বাংলা একাডেমি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের স্থাপনা থেকে তাঁর নিজের শেষ দিন পর্যন্ত ওই ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ছিলেন সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ। মুখে মুখে বলা তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের ঘটনার কথাশিল্প এই আত্মজীবনী। মূল ঘটনাবলি ১৯৬০ সাল পর্যন্ত হলেও প্রসঙ্গক্রমে পরের অনেক ঘটনাও চিত্রিত হয়েছে এই অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ
Salahuddin Ahmed- ১৯ অক্টোবর ২০১৪ আমাদের থেকে বিদায় নিয়েছেন বাংলার প্রবীণতম ইতিহাসবিদ সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ। তাঁর জন্ম ১৯২৪ সালে। শৈশব কেটেছে উত্তর বিহারের মতিহারিতে। স্কুলজীবন বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর, ফরিদপুর আর কলকাতায়। কলেজ কলকাতার রিপন ও প্রেসিডেন্সি। কৈশোর ও যৌবনে একদিকে বৃহত্তর বাংলার রূপ, অন্যদিকে মহানগর কলকাতার জীবন তাঁর স্বদেশপ্রেম, মানবতাবোধ ও ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাকে গড়ে তুলেছে। মার্কসীয় ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যোগ দিয়েছিলেন শ্রমিক আন্দোলনে। আবার মানবেন্দ্রনাথ রায়ের বিপ্লবী মানবতাবাদও তাঁকে টেনেছে। যৌবনে মহাত্মা গান্ধী আর প্রৌঢ় বয়সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর হৃদয়ে বিশেষ স্থান করে নিয়েছিলেন। শিক্ষকতা করেছেন জগন্নাথ কলেজ (১৯৪৮-৫৪), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৪-৭২), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭২-৭৮) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৭৮-৮৪)। উচ্চতর গবেষণা করেছেন পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কিয়েতো বিশ্ববিদ্যালয় ও সোয়াস-এ। ২০১১ সালে অভিষিক্ত হন বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপকের মর্যাদায়। পঞ্চাশের দশক থেকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনারে বহু প্রবন্ধ পাঠ ও বক্তৃতা দিলেও সালাহ্উদ্দিন আহ্মদের প্রথম বই প্রকাশিত হয় বেশ দেরিতে Social Ideas & Social Change in Bengal (১৯৬৫)Ñকলকাতা থেকে। তারপর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে বের হতে থাকে তাঁর প্রবন্ধ সংকলনসমূহ Bangladesh: Tradition & Transformation (১৯৮৭); বাঙালীর সাধনা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (১৯৯২); বাংলাদেশ: জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র (১৯৯৩);Bengali Nationalism & Emergence of Bangladesh (১৯৯৪); ইতিহাসের সন্ধানে (১৯৯৫); বাংলাদেশ: অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ (২০০০); উনিশ শতকে বাংলার সমাজচিন্তা ও সমাজবিবর্তন (২০০০); বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকট (২০০২); India, Pakistan, Bangladesh: Perspective on History, Society & Culture (২০০১, কলকাতা); বরণীয় ব্যক্তিত্ব, স্মরণীয় সুহৃদ (২০০৩); বাংলাদেশ কোন পথে (২০১২); ইতিহাস, ঐতিহ্য, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র (২০১৩), বঙ্গবন্ধু-বাঙ্গালি : সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সমকালীন ভাবনা (২০১৩)।