‘বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার’ বইয়ের কথাঃ একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মনিয়ন্ত্রনে অধিকার রক্ষায় এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় বাংলার মানুষ। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে মেলে প্রাণের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এ জাতির আত্মত্যাগ অনেক। পাকিস্তানি বর্বর বাহিনি সোনার বাংলায় চালিয়েছিল নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। তাদের এদেশীয় দোসররা যুক্ত হয়েছিল এসব কর্মকাণ্ডে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে তারা যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, শান্তিবিরোধী অপরাধসহ আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন করে অন্যান্য অপরাধ সংঘটিত করে। বাংলার মানুষকে চিরতরে বিলীন করে দিতে নিতে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনি নেয় পোড়ামাটির নীতি। কিন্তু বাংলার অকুতোভয় মানুষের দমে যায়নি। দেশ মাতৃকার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি এ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব যুদ্ধকালীন অপরাধ (যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, শান্তিবিরোধী অপরাধ) সংঘটিত হয় তার বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয় স্বাধীন বাংলাদেশে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন, এ দেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই। প্রয়োজনীয় আইন পাশ করা হয় জাতীয় সংসদ থেকে। ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনার বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সেসময়কার আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক নানা প্রেক্ষাপেট সেই ১৯৫ জন পাকিস্তানি অপরাধীর বিচার সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু দালাল আইনে চলতে থাকে এদেশীয় দালালদের বিচার। চিকন আলী নামে একজন অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়। কয়েকজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরেও ১১ হাজার দালালের বিরুদ্ধে চলতে থাকে বিচার। কিন্তু স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর থমকে যায় বিচারপ্রক্রিয়া। তারপরও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করার দাবি স্থিমিত হয়ে যায়নি। ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সূচিত হয় দুর্বার আন্দোলনের। গঠন করা হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় গঠিত হয় গণআদালত। জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর নানা কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন জোরালো থাকেনি। তারপরেও বিভিন্ন পরিসর থেকে বিচারের দাবি জাগ্রত থাকে। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে ওঠে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি। ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রস্তাব কণ্ঠভোটে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এরপর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ থেকে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়। এরইমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ থেকে ১৫টি মামলায় ১৬ জনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে নিষ্পত্তি হয়েছে কয়েকটি মামলা। একটি মামলায় রায় কার্যকর করা হয়েছে। জাতির জন্মপ্রক্রিয়ার বিরোধিতাকারী, মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্তদের বিচারের মুখোমুখি করে রায় কার্যকর করতে পারা একটি জাতির জন্য বিশাল অর্জনের। ব্যক্তিগতভাবে ২০০৭ সাল থেকে আমি যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে লেখালেখি করছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে চলা বিভিন্ন আন্দোলনে ও ক্যাম্পেইনে যুক্ত থাকার চেষ্টা করেছি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করেছি। সেই পর্যবেক্ষণের আলোকেই বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়ে একটি বই লেখার অভিপ্রায় হয়। দীর্ঘদিন ধরেই বইটির জন্য বিষয়বস্তু, তথ্য সংগ্রহ করছি। বিভিন্ন প্রিন্ট ও অনলাইন সংবাদপত্র থেকে বিভিন্ন তথ্য পেয়েছি। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। আমার এ বইটি থেকে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়আশয় জানা সম্ভব হবে আমি মনে করি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে জাতি ন্যায়বিচারের পথে হাঁটছে। এ যাত্রা সঠিক পথে থাকুক। যুদ্ধাপরাধী মুক্ত হোক প্রিয় বাংলাদেশ।