"প্রথম " বইয়ের ভূমিকা থেকে নেওয়া: সংকলন প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের প্রধান পরিচয়-সাহিত্যিক, এই সময়ের সেরা কথাকার। কথাসাহিত্যই ছিল তাঁর বিচরণের প্রধান ক্ষেত্র। তবে তা কখনাে একরৈখিক ছিল না। জীবনে যেমন, তেমনি সাহিত্যেও হুমায়ূন ছিলেন বৈচিত্র্যের সন্ধানী। আর সকল অবস্থায়ই জীবনের সৌন্দর্য আবিষ্কার উদ্ঘাটনই ছিল তার অন্বিষ্ট। এই অন্বেষাই তাঁকে নিয়ে গেছে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে। যাতে করে গড়ে উঠেছে বর্ণাঢ্য সাহিত্য-সম্ভার। মধ্যবিত্ত জীবনের আনন্দ-বেদনাকে উপজীব্য করে রচিত হয়েছে তার প্রথম লেখা এবং প্রথম প্রকাশিত দুটি ক্ষীণকায় উপাখ্যান শঙ্খনীল কারাগার এবং নন্দিত নরকে সাড়া পড়েছে আমাদের সাহিত্যের অঙ্গনে। বিষয়টি বহুল আলােচিত বিধায় তার পুনরুল্লেখ থেকে বিরত রইলাম। লক্ষণীয় একটি বিষয়ই উল্লেখ করছি। এই দুটি রচনা (এবং পরের আরাে কয়েকটিতে) দেখা যায় জরী, পরী প্রভৃতি কতিপয় নাম বারবার ফিরে আসছে। যদিও চরিত্রগুলাে সম্পূর্ণ আলাদা। নামের এ সাদৃশ্য কখনাে মনে হয় বিভ্রান্তিকর। কথা প্রসঙ্গে এ দিকটির প্রতি একদিন কবি শামসুর রাহমানের মনােযােগ আকর্ষণ করলে তার জবাবটা ছিল প্রণিধানযােগ্য। কবি বলেছিলেন, এ তাে মনে হয় বাস্তবতারই একটু ভিন্ন প্রতিফলন। চারপাশে তাকালেই তাে দেখা যায় একই নাম নিয়ে স্বতন্ত্র ব্যক্তির বিচরণ। নাম নয়, কর্মেই চরিত্রের পরিচয়। পরের পর্যায়ে মধ্যবিত্ত জীবনই মূল অবলম্বন থাকলেও হুমায়ূন তার রূপায়ণকে বিচিত্র করে তুলেছেন ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিত আর মাধ্যম প্রয়ােগের মাধ্যমে। নিয়ে এসেছেন. যুক্তি আর বিজ্ঞানেনিষ্ঠ মিসির আলিকে, তার বিপরীত অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছেন আবেগতাড়িত হিমুকে, শুদ্ধতার প্রতিনিধি হয়ে দেখা দিয়েছ প্রায়-দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শুভ্র । জীবনের সনাতন আবেগ প্রেমকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে হুমায়ূন কখনাে ভুল করেননি- জন্ম নিয়েছে উল্লেখযােগ্য সংখ্যক প্রেমের চরিত্র।
বাংলা সাহিত্যের এক কিংবদন্তী হুমায়ূন আহমেদ। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি লেখকদের মধ্যে তিনি অন্যতম স্থান দখল করে আছেন। একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও নাট্যকার এ মানুষটিকে বলা হয় বাংলা সায়েন্স ফিকশনের পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি বেশ সমাদৃত। বাদ যায়নি গীতিকার কিংবা চিত্রশিল্পীর পরিচয়ও। সৃজনশীলতার প্রতিটি শাখায় তাঁর সমান বিচরণ ছিল। অর্জন করেছেন সর্বোচ্চ সফলতা এবং তুমুল জনপ্রিয়তা। স্বাধীনতা পরবর্তী বাঙালি জাতিকে হুমায়ুন আহমেদ উপহার দিয়েছেন তাঁর অসামান্য বই, নাটক এবং চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের বদৌলতে মানুষকে করেছেন হলমুখী, তৈরি করে গেছেন বিশাল পাঠকশ্রেণীও। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমনি’ দেখতে দর্শকের ঢল নামে। এছাড়া শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, ঘেটুপুত্র কমলা প্রভৃতি চলচ্চিত্র সুধীজনের প্রশংসা পেয়েছে। অনন্য কীর্তি হিসেবে আছে তাঁর নাটকগুলো। এইসব দিনরাত্র, বহুব্রীহি, আজ রবিবার, কোথাও কেউ নেই, অয়োময়ো আজও নিন্দিত দর্শকমনে। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের জনক তিনি। রচনা করেছেন নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, জোছনা ও জননীর গল্পের মতো সব মাস্টারপিস। শিশুতোষ গ্রন্থ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক রচনা, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদ এর বই সমূহ এর পাঠক সারাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে। হুমায়ূন আহমেদ এর বই সমগ্র পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিতও হয়েছে। সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), একুশে পদক (১৯৯৪), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূধন দত্ত পুরস্কার (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮), শিশু একাডেমি পুরস্কার, জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদকসহ নানা সম্মাননা। হুমায়ূন আহমেদ এর বই, চলচ্চিত্র এবং অন্যান্য রচনা দেশের বাইরেও মূল্যায়িত হয়েছে৷ ১৯৪৮ সালের ১৩ই নভেম্বর, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলায় কুতুবপুরে পীরবংশে জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের বেলভ্যু হাসপাতালে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। গাজীপুরে তাঁর প্রিয় নুহাশ-পল্লীতে তাঁকে সমাহিত করা হয়।