উপন্যাসের আখ্যান যেখানে শুরু তার পূর্বেও অনত্মপ্রসারী আখ্যানভাগ অলিখিতই থেকে যায়। উপন্যাসের যেখানে শেষ তারপরেও তার বিশাল বিস্তার অকথিতই পড়ে থাকে। তাই উপন্যাসের আঙ্গিক জটিল এবং রহস্যময়। ঠিক তেমনি একাত্তরের যুদ্ধ যার শুরুর রক্তবীজ গোপনে বাহিত ছিল প্রাচীন আদিবাসীর রক্ত আর প্রাণে। তাই এই উপন্যাসে জন-জাতির জীবনের সঙ্গে একাত্তরের শুরুটা আছে, কিন্তু শেষ নেই। উপন্যাসে আমি নিম্নবর্গ-জীবনের যে ছবি এঁকেছি এবং শীতলক্ষ্যার বর্ণনা দিয়েছি তা দূর অতীত আমার শৈশব স্মৃতির। নিকট অতীতটা কেবল একাত্তরের যুদ্ধ। বর্ণিত সেই অঞ্চলের রূপান্তর ঘটে গেছে নগর আর শিল্পায়নের ফলে। সেই নদী আর মৎস্যজীবী বা মাঝি-মালো জনবসতি আজ আর নেই। নদী তীরবর্তী প্রকৃতিও অদৃশ্য। ওই যে বাণেশ্বর পাখির লোককথা বলেছি তার ইতিহাস আমার প্রয়াত পিতার মুখে শোনা শৈশব স্মৃতি। একটি নিম্নবর্গ নারীর ভেতর যে প্রতিহিংসা, প্রতিশোধবাসনা বর্ণিত হয়েছে তা আসলে নিম্নবর্গের বিদ্রোহেরই প্রতীক। ওই নারীর শক্তি-সাহস অমোঘ ইতিহাসেরই অংশ। যা অমীমাংসিত থেকে যায় তা হচ্ছে ধর্ষিতা নারীর প্রেমের অচরিতার্থতা। এতো হাজার বছরের পুরুষতান্ত্রিকতা, প্রাচীন অনড় সামাজিক-গৌত্রিক সংস্কার। এই জটিল উপলস্তূপ ভাঙতে পারে না একাত্তরের যুদ্ধ আর বিজয়ের অভিঘাত। অন্যদিকে একাত্তরের ধর্ষণ, নরহত্যা, শত্রুর ধর্মের নামে পৈশাচিকতার রক্তবীজ তো স্বাধীন দেশটিও অদৃশ্যে বহন করেই চলে। মনুষ্যত্বের মুক্তি আর মেলে না। সভ্যতার এ বড় নির্মম অনতিক্রান্ত অতলান্তিক অন্ধকার।
হরিপদ দত্ত। জন্ম : ২ জানুয়ারি ১৯৪৭ খ্রি. গ্রাম : খানেপুর, উপজেলা : পলাশ, জেলা : নরসিংদী। উল্লেখযোগ্য উপন্যাস: অজগর, জন্মজন্মান্তর, দ্রাবিড় গ্রাম, মোহাজের, চিম্বুক পাহাড়ের জাতক (৪ খণ্ড) প্রভৃতি। গল্প সমগ্র, প্রবন্ধ সমগ্র ও শিশু-কিশোর সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে। পুরস্কার : বাংলা একাডেমি পরিচালিত সাদ’ত আলী আকন্দ সাহিত্য পুরস্কার ২০০১ এবং বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০০৬ (উপন্যাস)।