‘বিসর্গতে দুঃখ’ বইয়ের ফ্ল্যাপের কথাঃ বিসৰ্গতে দুঃখ কেন? কারণ কি এই যে বিসর্গ দেখতেই চোখের পানির মতো? গুড়ো গুড়ো অশ্রুর মতো? কারণ কি এই যে জীবনের নদীতে সুখ ভেলা মাত্র, বাকিটুকু দুঃখ? হয়তো বা, হয়তো বা নয়। তবু শাহাদুজ্জামান কয়েকটি বিহবল গল্প দিয়ে শুরু করে পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ লেখার পর যখন বলেন, বিসৰ্গতে দুঃখ, তখন বিষয়টাতে মনোযোগ দিতেই হয়। কারণ, পাঠকের মনোযোগ দাবি করার পূর্বশর্ত শাহাদুজ্জামান তাঁর আগের দুটো বইয়ে পূরণ করেছেন। মেটাফিকশন বলে এক ধারার আধুনিক (অথবা উত্তর-আধুনিক) সাহিত্য পৃথিবীতে তৈরি হয়েছে। আমার মতো করে আমি বুঝি যে এর প্রকরণ, চেহারা এবং স্বাদ অন্য রকম। এই কথাসাহিত্য আধুনিক মন ও মননের অবশ্যম্ভাবী ফল। হোর্হে লুইস বোর্হেস (দি আলেফ অ্যান্ড আদার স্টোরিজ গ্রন্থের গল্পসমূহ), অমিতাভ ঘোষ (ইন অ্যান অ্যান্টিক ল্যান্ড) এবং সম্ভবত আরও অনেক বিদেশি মেটাফিকশন লিখেছেন; বাংলাদেশে বাংলা ভাষায়ও তা লিখিত হওয়ায় আপত্তির কোনোই কারণ নেই। মনে হয় যে শাহাদুজ্জামান মেটাফিকশন লিখছেন। কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহির
ভূমিকা বিসৰ্গতে দুঃখ বইটা প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালে শ্রাবণ প্রকাশনী থেকে। বইটার প্রচ্ছদ করেছিলো বন্ধু চিত্রকর ঢালী আল মামুন। বইটার প্রথম সংস্করণ অনেকদিন আগেই নিঃশেষ হয়েছিলো। দীর্ঘদিন পর নতুন প্রচ্ছদে, নতুন আঙ্গিকে বইটা প্ৰকাশ করলো বাঙলায়ন। এজন্য ধন্যবাদ জানাই বাঙলায়নের স্বত্বাধিকারী অস্ট্রিক আয়ুকে। বইটা প্রকাশিত হবার পর পত্রপত্রিকায় এনিয়ে নানাবিধ আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে বইটার ব্যতিক্রমী প্রকরনের ব্যাপারে মনোযোগ দিয়েছেন অনেকে। এটা গল্প, উপন্যাস না প্ৰবন্ধ এমন প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহির এই বইটা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে একে বলেছিলেন। মেটাফিকশন। বইটাকে বিশেষ কোনো তকমা পড়ানোর ব্যাপারে আমার আগ্রহ নাই। চেক লেখক মিলান কুন্ডেরা একবার একটা ব্যক্তিগত ডিকশনারী লিখেছিলেন, যেখানে তিনি ডিকশনারীর শব্দগুলোকে নিজের মতো করে অর্থ করেছিলেন। সেই বইটা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিলো। বলা যায়। সেই বইয়ের অনুপ্রেরণায় আমি একটা ব্যক্তিগত বর্ণমালা বই লিখতে উদ্যোগী হয়েছিলাম। একে একটা বড়দের বর্ণমালা বইও বলা যেতে পারে! এই বইকে কেন্দ্র করে আমার ব্যক্তিগত আনন্দের স্মৃতি এই যে বইটা নিয়ে লিখেছিলেন আমার প্রিয় একজন লেখক প্ৰয়াত শহীদুল জহির । শহীদুল জহির তাঁর লেখক জীবনে এই একটামাত্র গ্রন্থসমালোচনাই করেছিলেন। সে লেখাটার ইতিহাসমূল্য বিবেচনা করে, পরিশিষ্ট শহীদুল জহিরের গ্রন্থসমালোচনাটা এই বইয়ের শেষে যুক্ত করে দিলাম। শাহাদুজ্জামান ফেব্রুয়ারি ২০১৫
সমসাময়িক বাংলা কথাসাহিত্যে মননশীল সাহিত্যিক হিসেবে শাহাদুজ্জামানের অবস্থান অনন্য ও অগ্রণী। গল্প, উপন্যাসেই বেশি পরিচিত হলেও শাহাদুজ্জামানের উল্লেখযোগ্য কাজ রয়েছে প্রবন্ধ, অনুবাদ, ভ্রমণ এবং গবেষণার ক্ষেত্রেও। লেখকের মতে, তিনি আল বেরুনীর মতো দীর্ঘ নয়, বরং বিস্তৃত জীবনের আকাঙ্ক্ষা করেন। ১৯৬০ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন কথাশিল্পী শাহাদুজ্জামান। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করেন মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে। এরপর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের গ্রামীণ স্বাস্থ্য প্রকল্পে। উচ্চতর শিক্ষার জন্য পরবর্তীতে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং নেদারল্যান্ডসের আমস্টার্ডাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনে শাহাদুজ্জামান দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ বিভাগে। বর্তমানে তিনি যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও গবেষণা কাজের সাথে যুক্ত রয়েছেন। পারিবারিকভাবে সাহিত্যের যে ঘোর শৈশবেই আচ্ছন্ন করেছিলো তা-ই শাহাদুজ্জামানের সাহিত্যিক হয়ে ওঠার পাথেয় হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৯৬ সালে মাওলা ব্রাদার্স আয়োজিত কথাসাহিত্যের পান্ডুলিপি প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়ে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম ও ছোটগল্পগ্রন্থ ‘কয়েকটি বিহ্বল পাখি’। শাহাদুজ্জামান এর বই সমূহ ঠিক প্রচলিত উপন্যাসের গৎবাঁধা আঙ্গিকে ধরা যায় না। অনেক সাহিত্যবোদ্ধা তাই তাঁর লেখাকে ফিকশন-নন ফিকশন, পদ্য-কথাসাহিত্য, সবকিছুর মিশেলে ‘ডকু ফিকশান’, আবার অনেকে ‘মেটাফিকশান’ বলে রায় দিয়ে থাকেন। শাহাদুজ্জামান এর বই সমগ্র এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক্রাচের কর্নেল, আধো ঘুমে ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে, একটি হাসপাতাল একজন নৃবিজ্ঞানী কয়েকটি ভাঙ্গা হাড়, ক্যাঙ্গারু দেখার শ্রেষ্ঠ দিন এবং অন্যান্য অনুবাদ গল্প, কয়েকটি বিহ্বল গল্প, মামলার সাক্ষী ময়নাপাখি, কাগজের নৌকায় আগুনের নদী, এবং কবি জীবনানন্দ দাশের উপরে লেখা উপন্যাস ‘একজন কমলালেবু’। কমলা রকেটসহ বেশ কিছু চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও রচনা করেছেন শাহাদুজ্জামান। ২০১৬ সালে বাংলা কথাসাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পান বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার।