মাঝে মধ্যে লেখার ইচ্ছা একেবারেই থাকে না। শরীরও সায় দেয় না। মনও সম্মত হতে চায় না। এ অবস্থাতেও আমি লিখি। কারণ না লিখলে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা যায় না। আমি আজকাল অন্তত লেখার ব্যাপারে কোনো প্রতিশ্রুতিতে যেতে চাই না। কথা দিই না। কারণ কথা রক্ষা করা আর আমার দ্বারা হয়তো সম্ভবপর নয়। তবু লেখার জগৎ বলে একটা কথা আছে। সেখানে তো গড়িমসি করা বা এটা-ওটা বলে পার পেয়ে যাওয়া চলে না। এভাবেই একটা দীর্ঘজীবন কাটিয়ে দিয়েছি একথা ভাবলে শরীর থেকে ঘাম ঝরতে থাকে। কথা আছে না, লেখকের পেছন ফিরে তাকাতে গেলে পিছুটান বৃদ্ধি পায়। ছেড়ে এসেছি, ছাড়িয়ে এসেছি। এখন আগ বাড়িয়ে যেতে চাই। কত মানুষ তো দেখলাম। মানুষ দেখে তবু কেন আমার সাধ মিটল না। এ জন্যই কি যে আমি আমার নিজেকে অত্যন্ত ভালোবাসি? হতে পারে। কবি যখন তখন নিজেকে ভালোবাসার একটা বিষয় তো থাকবেই। নিজেকেই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখা, নিজের ভালোমন্দের বিচার করা-এসব তো আছেই। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো নিজের সমালোচনা করা। এখানেই যত গোল বেঁধে যায়। নিজের সমালোচনা করতে গেলেই এমন সব লোভলালসার কথা বেরিয়ে পড়ে, যা মানুষকে শান্তিতে এবং স্বস্তিতে থাকতে দেয় না। অথচ কবির প্রধান কাজই হলো স্বস্তি অন্বেষণ। আমিও খুঁজি। কী যে খুঁজি সেটা হয়তো আমারই ঠিকমতো জানা নেই। খুঁজতে খুঁজতে চলেছি। পথ দীর্ঘ: কিন্তু মানষের আযষ্কাল কত কম!
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন আল মাহমুদের কবিতার বই পড়েননি এমন সাহিত্যপ্রেমী খুঁজে পাওয়া ভার। গুণী এই কবি একাধারে একজন সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। তবে সবকিছু ছাপিয়ে গেছে তার কবি পরিচয়। আধুনিক বাংলা কবিতা নানা দিক থেকে তার কাছে ঋণী থাকবে। বাচনভঙ্গি আর রচনাশৈলীতে তার কবিতা সমকালীন যেকোনো কবির তুলনায় অনন্য। ‘কবিতাসমগ্র’ (দুই খন্ড) ‘উড়ালকাব্য’, ‘সোনালি কাবিন’, ‘আল মাহমুদের স্বাধীনতার কবিতা’, ‘প্রেমের কবিতা সমগ্র’, ‘আল মাহমুদের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ইত্যাদি কবিতার বই নিয়ে আল মাহমুদ কবিতাসমগ্র। এছাড়াও আল মাহমুদ উপন্যাস সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে তিন খণ্ডে। জাতীয় রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক টানাপোড়েন, স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি ও প্রেক্ষাপটসহ সমাজ ও ব্যক্তি জীবনের দ্বন্দ্ব স্থান পেয়েছে আল মাহমুদ এর বই সমূহ-তে। ‘কালের কলম’, ‘লোক লোকান্তর’, ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’, ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’, ‘গল্প সমগ্র’, ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য লেখা। আল মাহমুদের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে। তার পুরো নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। শিক্ষাজীবনেই তিনি লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত হন। রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল আর মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলী পাঠ করতে করতে নিজের কবি প্রতিভা আবিষ্কার করেন তিনি। ১৯৫৪ সালে সাপ্তাহিক কাফেলা পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। কিছুকাল পরই এ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। পুরো ৬০-এর দশক জুড়ে তিনি অসংখ্য কবিতা রচনা করেন এবং কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি প্রবাসী সরকারের হয়ে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ পত্রিকায় সরকার বিরোধী লেখালেখির কারণে এক বছরের জন্য কারাদণ্ডও ভোগ করতে হয় তাকে। ১৯৭৫-৯৩ সাল পর্যন্ত শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে কাজ করে কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কবি আল মাহমুদ তার অনবদ্য রচনাশৈলীর জন্য ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’, ‘একুশে পদক’, ‘জীবনানন্দ স্মৃতি পুরস্কার’, ‘নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক’ সহ অসংখ্য পদক ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ২০১৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি তিনি পরলোকগমন করেন।