বাংলা সাহিত্যের শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বড়দের সাহিত্যেও ভূতের গল্পের দুর্দান্ত দাপট। কিন্তু ভূত বলে কি কিছু আছে? এ প্রশ্নের উত্তর আরো বেশি রহস্যময়। সত্যিকারের ভূত আছে কি নেই তার থেকেও মানুষের কল্পনায় যে ভূত আছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের আড্ডা আলাপের অন্যতম একটি বিষয় হলো ভূত। ভূত নিয়ে যে কতো রকম অভিজ্ঞতা আছে! আছে গল্প কবিতা ছড়া সিনেমা নাটক তার হিসেব মেলানো যাবে না। পৃথিবীর সব দেশে, সব সাহিত্যে, সব সংস্কৃতিতে ভূত নিয়ে রয়েছে নানা রকম ঘটনা। ‘ভূতের বাড়ি ভূতের গলি’ শিরোনামে নাসিরুদ্দীন তুসীর লেখা একটি ভূতের গল্পের বই। বইটিতে রয়েছে ভূত নিয়ে তিনটি গল্প, ভূতের বাড়ি ভূতের গলি, আমাদের ভূতবন্ধু ও ভূতুড়ে বাড়ি। এ গল্পগুলো স্থান কাল চরিত্র অনেকটা পরিচিত হলেও এর ঘটনাগুলো ভয়ংকর! ছোট ছোট বাক্যে গল্পের চরিত্রগুলো একত্রিত করতে পারেন নাসিরুদ্দীন তুসী। গল্পগুলোর সবগুলোই প্রধান চরিত্র শিশু-কিশোর। শিশু-কিশোর মনে যে কল্পনা ও ভাবনা তার একটি বড় অংশ জুড়ে ভূত। তারা কোথাও বেড়াতে গেলে সেখানে ভূত আবিষ্কার করতে পারে। ছোট ছোট ঘটনাকে কল্পনার সহযোগে করে তুলতে পারে অদ্ভূতুরে। যেমন ‘ভূতের বাড়ি ভূতের গলি’ গল্পে শাওন ঈদের ছুটিতে কয়েকদিন গ্রামের বাড়িতে থেকে ঢাকায় ফেরার পরে ঘটে এসব ঘটনাÑ ড্রয়িংরুমের দরজা খুলতেই তীব্র আলোতে শাওনের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখে ওদের কাজের ছেলে রহিমের লাশ পড়ে আছে। চারিদিক রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ভয়ে শাওনের শরীর যেন অবশ হয়ে এলো। রহিমের লাশ! রহিমের লাশ এখানে এলো কেমন করে? রহিম তো আজ থেকে প্রায় ছমাস আগে ডাকাতদের হাতে...। তাদের গ্রামের বাড়িতে তাকে কবরও দেয়া হয়েছিল। শাওন কি স্বপ্ন দেখছে তাহলে? ‘না, স্বপ্ন না। তোরা আমার ছেলেকে খুন করছস্, আমিও তোরে খুন করমু।’ ঠিক শাওনের পিছন থেকে কে যেন খনখনে গলায় বলল। তারপর এক ধাক্কায় ফেলে দিল শাওনকে। সোফার উপর পড়ে গিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো, সেই রিকশাঅলা। আগুনের ভাটার মতো চোখদুটো জ্বলছে। লকলক করছে জিহŸা তার’। ভয়াবহ একটি অভিজ্ঞতা মেলে এ গল্প পাঠে। ঘটনার শেষ না হতেই গল্প শেষ হয়ে যায়। ফলে পাঠক মনে বাড়ে আরও কৌতুহল! শেষে কি হয় শাওনের? আসলে ভূতের গল্পের এই সব চমক না থাকলে জমে ওঠে না। পড়তে পড়তে শিহরিত হয়ে ওঠা। ভয়ে গা শিরশির করা এসব না হলে যেনো ভূতের গল্প পড়ার মজাই আসে না। কিন্তু এমন করে গল্প লিখতে সবাই পারে না। নাসিরুদ্দীন তুসী এ ক্ষেত্রে সফল বলা চলে। এই বইটির একটি মজার গল্প হলো, ‘আমাদের ভূতবন্ধু’। ‘সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে। দূরে কোথাও অচেনা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। আমাদের কারো মুখে কোনো কথা নেই। যত দ্রæত হেঁটে এ জায়গা পার হতে পারি তত ভালো। ঠিক সে সময় কে যেন নাকি সুরে কেঁদে উঠল, ‘বাঁচাও, বাঁচাও।’ কণ্ঠটা খুবই ক্ষীণ কিন্তু খুব কাছে কোথাও। এদিক সেদিক চোখ বুলাতেই আমরা চারজন একসাথে চমকে উঠলাম। দেখি হ্যাংলা মতো, মিশমিশে কালো, হাড্ডিসার, আমাদের বয়সি একটা ছেলে শিমুলগাছের নীচে বসে কাঁদছে আর ভয়ার্ত কণ্ঠে ডাকছে, ‘বাঁচাও, বাঁচাও।’ আসলে এটি কোনো মানুষ নয়। ও হলো একটি ভূতের ছানা! ভূতের যেমন সাহস শক্তি থাকে তার কিছুই নেই ওর মধ্যে। তাই ভূতেদের বাড়ি থেকে ওকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। চার বন্ধুর সাথে যখন ঠেঙা ভূতের পরিচয় হয় তখন বলে ওর দুঃখের কথা- ‘সেঁ আঁর বঁলো না ভাঁই, আঁমি ভীতু আঁর বোঁকা বঁলে আঁমার বাঁবা আঁমাকে বাঁড়ি থেঁকে তাঁড়িয়ে দিঁয়েছে। আঁর সাঁরাদিন ক্রিঁকেট খেঁলি বঁলে মাঁও আঁমাকে দুঁচোখে দেঁখতে পাঁরে নাঁ। তাঁর ওপর তিঁনি আঁমার আঁসল মাঁ নঁয়, সঁৎমা।’ ভূতের দুঃখে ছলছল করে উঠল রাশেদের চোখ। বলল, ‘ঠিক আছে বন্ধু, তোমাকে আমরাই নিয়ে যাব।’ কিন্তু কীভাবে তাকে বাড়ি নেব তার কোনো সমাধান খুঁজে পেলাম না। ঠেঙা আমাদের সমস্যা বুঝতে পারল। ‘শোঁন বঁন্ধুরা! আঁমি যঁখন যেঁমন ইঁচ্ছে সেঁই রূঁপ ধাঁরণ কঁরতে পাঁরি। তোঁমরা আঁমাকে ব্যাঁট বাঁ বঁল বাঁনিয়ে বাঁসায় নিঁয়ে যেঁতে পাঁরো।’ এই বলে হঠাৎ ভূতটা ক্রিকেট বল হয়ে গেল। আমাদের ভূতবন্ধু ঠেঙা চমৎকার ক্রিকেট খেলে। প্রয়োজনে সে বল হয়ে যায়, প্রয়োজনে ব্যাট হয়ে যায়। কখনো কখনো আমাদের রূপ ধরেও সমানে খেলতে লাগল। আর সে আমাদের সাথে থাকা মানেই আমাদের জয় নিশ্চিত। সে এখন আমাদের খুবই প্রিয় বন্ধু।’ বইটির তিনটি গল্পই অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ভূত নিয়ে আসলে বানিয়ে বানিয়ে অনেক গল্প বলা যায়। কিন্তু সব গল্পের তো আর মেধা থাকে না। এ গল্পগুলো পাঠক মনে দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে আশা করা যায়।
কবি, শিশুসাহিত্যিক। পিতা : আবদুল হক, মাতা : হালিমা খাতুন। পৈতৃক নিবাস : ফেনী সদর উপজেলার বারাহিপুর গ্রাম। কিশোর কবিতা : মাঠের শেষে দূরের দেশে, ঘরপালানো দুপুর, আলোর নাচন পাতায় পাতায়। ছড়া : কালের ছড়া। কবিতা : জোছনার বৃষ্টি। কিশোর গল্প : পরির জন্য ভালোবাসা, রহস্যময় রাতের ট্রেন। শিশুতোষ গল্প : ময়ুরপরি, শেয়াল ও মুরগীছানা, পরি রাজকন্যা, আমাদের বন্ধু জাহিন, বাড়ি থেকে পালিয়ে, সাতভাই চম্পা, ডালিম কুমার, রূপকুমারের গল্প, সুখু দুখ ও চাঁদের বুড়ি,। অনুবাদ : আতশ পাখির সন্ধানে। প্রবন্ধ- গবেষনা-জীবনী: কবি নজরুল : বিচিত্র জীবনের গল্প, রবীন্দ্রনাথের আনন্দলোক, জীবনানন্দ দাশ: বিচিত্রজীবন। পাঠ্যপুস্তক ও রেফারেন্স বুক : জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (NCTB) Gi Supplemen:ary Reading Me:arial এ প্রথম থেকে দশম শ্রেণির বইতে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে ১৩টি ছড়া ও কিশোরকবিতা। ৩টি গবেষণাগ্রন্থ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রেফারেন্স বুক’ এর অর্ন্তভ‚ক্ত। পুরস্কার ও সম্মাননা : Unicef ‘মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড ২০১৭’, মাদার তেরেসা সাহিত্য পুরস্কার, জাতীয় কবি নজরুল সম্মাননা পদক-২০১৬, শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি পদক-২০১৫, জেলা প্রশাসক সম্মাননা পদক-২০১৫ (মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসন আয়োজিত), সেলিব্রেটিং লাইফ লিরিক অ্যাওয়ার্ড-২০১০ (ডেইলী স্টার ও স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক আয়োজিত), ছোটদেরমেলা ‘সেরাবই’ পুরস্কার (২০১০), সুনীতি অ্যাওয়ার্ড-২০০০ সহ অন্যান্য পদক ও সম্মাননা। সাংস্কৃতিক ও সাংগঠনিক কার্যক্রম : সদস্য : বাংলা একাডেমি। আজীবন সদস্য : ঢাকা ইউনিভার্সিটি এলামনাই এসোসিয়েশন। রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ফেনী সমিতি, ঢাকা।