সুরুজ মিয়ার একটা নৌকা আছে। এই নৌকাটাই তার একমাত্র সম্বল। এই নৌকার মাঝেই তার ঘর—সংসার সব। সে এখন আর চোখে দেখে না। আগে আবছা আবছা দেখতো। তার যখন থেকে চোখের আলো কমে আসে তখন থেকেই ফিরুজ মাছ ধরতে শুরু করে। ফিরুজ তার একমাত্র ছেলে। চোখে দেখতে পাওয়ার আগ অবধি সুরুজ মিয়াই মাছ ধরতো। ফিরুজ এখনো মাছ ধরার কৌশলটা আয়ত্ত করতে পারেনি ভালোভাবে, তাও ধরছে কম বেশি। ফিরুজ যেদিন একদমই মাছ পায় না সেদিন তাদের কারোরই আর খাওয়া হয়ে উঠে না। ক্ষুধার যন্ত্রণায় চোখ ভরে আসে জলে কখনো কখনো। আহা, সে কি যন্ত্রণার? সেদিন কোনো আনন্দ তো থাকেই না তাদের। আর যেদিন অনেক মাছ পায়, জাল ভরে আসে মাছে সেদিন তো তাদের আনন্দের আর কোনো সীমা থাকে না। তাদের আনন্দ বেদনাটা থাকে কেবল মাছ পাওয়া না পাওয়ার মাঝেই। এছাড়া তাদের আর কোনো আনন্দ বেদনা নেই। তাদের স্বপ্নটা যেন বন্দি থাকে মাছ ধরার জালের ভেতর। আর ভয় তো থাকেই। নৌকায় করে কোনো না কোনো ডাকাতদল এসে স্বপ্নবন্দী এই জাল ছিনিয়ে নেওয়ার ভয়। নিয়েও যায় অবশ্য। কেবল জালই নিয়ে যায় না, সাথে করে নিয়ে যায় সুরুজ মিয়ার আর কমলাবিবির জীবনও। কমলাবিবি সুরুজ মিয়ার স্ত্রী। সাজানো গোছানো নৌকাটাকে যেন একেবারে এলোমেলো করে দিয়ে যায়, লন্ডভণ্ড করে দিয়ে যায় স্বপ্ন, আশা সবকিছুকেই। তাও জীবন থেমে থাকে না। জীবনের যেভাবে চলার কথা সে ঠিক সেভাবেই চলে। এলোমেলো হয়ে যাওয়া নৌকাটাকে ফিরুজ আবার সাজাতে শুরু করে, স্বপ্নবন্দী যে জাল ছিনিয়ে নেয় ডাকাতরা সে জাল আবার বুনতে শুরু করে হামিদা। হামিদা ফিরুজের স্ত্রী। সেও এক জেলে কন্যা। সে আবার জাল বুনতে পারে ভালো। নতুন করে জাল বুনে যেন ফিরুজের ভেঙে যাওয়া স্বপ্নটার জোড়া এই হামিদাই লাগায় কেবল।
আরিফ খন্দকার। বুকের ভেতর অজস্র গল্প বয়ে বেড়ান। মানুষের গল্প, জীবনের গল্প। সেইসব গল্পই তিনি বলে যেতে চান কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে। তাইতো একের পর এক লিখে চলছেন। আমৃত্যু লিখে যেতে চান। তাঁর লেখা যখন বই আকারে প্রকাশ হয় তখন তাঁর কাছে মনে হয় এটা একটা বই-ই না। আসলে এটা একটা মানুষ, এটা একটা জীবন। এভাবেই তিনি মানুষ, জীবন তৈরি করে চলছেন ২০১৫ সাল থেকে। ২০১৫ সালের একুশে বইমেলায় প্রকাশ হয় তাঁর প্রথম বই। এখন পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৬। দুটো কাব্যগ্রন্থ ও চৌদ্দটি উপন্যাস। তাঁর কাছে এই ষোলোটিকে বই মনে হয় না। মনে হয় মানুষ, মনে হয় জীবন। এই ষোলোজন মানুষ পাঠকের দুয়ারে ঘুরে ঘুরে তারা তাদের জীবনের গল্প শুনায়। এভাবে আরো মানুষ তৈরি করায় ব্যস্ত তিনি শুধুমাত্র তাদের জীবনের গল্প পাঠকরা শুনবে বলে। মানুষ ও জীবন তৈরি করার এই মানুষটির জন্ম ২৩ আগস্ট ১৯৯৭ সালে নরসিংদী শহরে। খুব ছোটবেলা থেকেই তাঁর বই পড়া শুরু। বই পড়তে পড়তে যখন তাঁর মনে হলো তাঁর ভেতর নদীর জলের মতো তিরতির করে গল্প বয়ে বড়াতে শুরু করছে তখনই তিনি লিখতে শুরু করেন। শুরুটা ছোটগল্প দিয়ে হলেও কবিতা ও উপন্যাস লিখতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তাঁর কাছে মনে হয় কবিতা ও উপন্যাসে মানুষের জীবন যতটা গভীরভাবে অনুধাবন করা যায় ততটা গভীরভাবে আর কোনোকিছুতে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। কারণ কবিতা ও উপন্যাসই মানুষের কথা বলে, জীবনের কথা বলে। বলতে বলতে আবার মানুষ হয়, জীবনও হয়। এই মানুষ আর এই জীবন দেখতেই খুব পছন্দ করেন তিনি। তাইতো সবকিছু থাকা সত্ত্বেও একা, নিঃসঙ্গ হয়ে আছেন লেখা নিয়ে। অবশ্য এটাকে একা, নিঃসঙ্গও বলা যায় না, বলা যায় তিনি মানুষের ভিড়ে জীবনের গল্প বলায় ব্যস্ত।