উহ্ কী ভয়ংকর এক পরিভ্রমণ! অথচ কবি তার কাব্যযাত্রা শুরু করে ছিলেন তিমির হননের অভিযাত্রী হয়ে। কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতায় কবির দৃপ্ত উচ্চারণ- ‘আমার অনাগত সুরের মূর্ছনা ভবিষ্যতের গান/ চন্দ্র-সূর্যের মতো সত্যে বিভোর আমার পৃথিবী’ (পৃ. ৩৯) তিমির হননের অভিযাত্রী কবিতায় কবি বারংবার ‘আমি যাচ্ছি আমি যাচ্ছি আমি যাচ্ছি আমি যাচ্ছি’ বলে আপ্তবাক্য উচ্চারণে মগ্ন ছিলেন। সমগ্র কাব্যগ্রন্থে জন্মভূমি, প্রেম, দোহ, শৈশব,কৈশোরের স্মৃতি, ভাষা, মুক্তিযুদ্ধ, শেষ বিচারের চিন্তা,মাতৃপ্রেম, স্রষ্টা ও সৃষ্টি, মধুশয্যা, বন্ধুত্ব, বিচারের আর্তি... মোট কথা, যাপিত জীবনের সকল বিষয়ে রেখাপাত করে কবি অবশেষে এক ‘রাক্ষস’ এর মুখোমুখি হন। এই রাক্ষস- কালের রাক্ষস! তার অত্যাচারে ব্যতিব্যস্ত আজ দেশ-কাল-পাত্র। অদম্য এই রাক্ষসকে উদ্দেশ্য করেই কবির সৃষ্টি ‘রাক্ষস নগরে হাঁটছি'। ‘রাক্ষস নগরে হাঁটছি’ কবি আনিসুর রহমান বাবুল-এর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশনা সংস্থা ‘সাহিত্যদেশ ‘থেকে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থটিতে সর্বমোট ৫৪টি কবিতা ঠাঁই পেয়েছে প্রতিটি কবিতাই কবির ব্যক্তিজীবনের সুখ-দুঃখে লালিত এবং জাতীয় জীবনের উজ্জ্বল অনুষঙ্গে অনুপ্রাণিত। মূলত করোনাকালের বেদনা বোধের মধ্যে মুখচাপা রাজনৈতিক বেদনার কথাই ব্যক্ত করতে চেয়েছেন তার কাব্যগ্রন্থে। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল মার্চের পরেই তার জন্ম। তাইতো মাতৃজঠরেই তার মুক্তিযুদ্ধের রক্তবীজ সৃজিত। সেই অনিবার্য চেতনায় তিনি লিখেছেন; কবিতা- ‘একটা আঙুলি নির্দেশনায়’ (পৃ-১৮)। কবিতায় তার দেশপ্রেমী উচ্চারণ- ‘একটা আঙুলি নির্দেশনায় মরা নদী হয়ে ওঠে, চির যৌবনা ফলবতী হয়ে ওঠে বৃক্ষরাজি’। কবির আধ্যাত্বপ্রেম জাগ্রত হয়েছে তার ‘শেষ বিচারের পারাপারে’ (পৃ-২১), ‘অসীম মহাকালে দিবারজনী খণ্ডিত জীবন’ (পৃ-২৫) ‘মাওলা রে’ (পৃ-৪৬) ‘হে দয়াময়’ ( পৃ. ৫২) ‘তোতাপাখি রে’ (পৃ-৫৫) ইত্যাদি কবিতা সমূহে। কবি-বৃত্তান্তে জানা যায়- ছড়া দিয়ে তার লেখালেখির হাতেখড়ি। সেই প্রতিফলন আমরা তার আলোচ্য কাব্যগ্রন্থে পাই। ছড়াকাব্যে তার মুন্সিয়ানা আছে বেশ। গ্রন্থের অন্ত্যমিলযুক্ত ছন্দময় লেখাগুলোই তার প্রমাণ। পাঠক অনায়াসেই ছড়ার সরল সুখপাঠ্য স্বাদ পেতে পড়ে নিবেন- ভুল (পৃ-১০), ঝড় এলো (পৃ-১২) হলুদ পাখির ছানা (পৃ-২৩) বাংলা ভাষায় (পৃ-১৯), মা যে আমার (পৃ-২৮), বাংলা আমার (পৃ-২৬) ‘ইচ্ছে করে’ (পৃ-২৮) ফটকা চাচা (পৃ-৪৪), শ্যামল বাংলাদেশে (পৃ-৫০), টুনাটুনি গান (পৃ-৬১) - ইত্যাদি ছড়াগুলো। ছন্দময় এই ছড়াগুলো পাঠকগণ পড়ে কবির কাছে আগামীতে একটি শিশুতোষ ছড়ার বই আশা করতেই পারেন। শব্দ চয়নে, উপমা-উৎপ্রেক্ষায় কবি আধুনিকতার পথেই হেঁটেছেন। তাইতো ‘রাক্ষস নগরে হাঁটছি’ কাব্যগ্রন্থে কবি সুন্দরতম শব্দ চয়নে নান্দনিক সব পঙ্ক্তি রচনায় সাবলিল কবিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।
জন্ম ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮ বাংলা, ২৫ মে ১৯৭১ খ্রি.। নেত্রকোনা জেলা বারহাট্টা উপজেলার শিমুলিয়া গ্রামে। বাবা মরহুম ইব্রাহিম তালুকদার, মা তালুকদার রোকেয়া ইব্রাহিম, স্ত্রী বিউটি আক্তার, দুই সন্তান বৃষ্টি ও বিথি। শিক্ষাগত যোগ্যতা এমএ (দর্শন)। শৈশবে ছড়া লেখার মাধ্যমে লেখালেখি শুরু। ছাত্রাবস্থায় জাতীয় দৈনিক আজকের কাগজ সিলেট অফিস এর সহযোগী সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি স্থানীয় জাতীয় প্রায় সব পত্রিকায় ছড়া, কবিতা, প্রবন্ধ, ফিচার, গ্রন্থ আলোচনা ইত্যাদি লিখেছেন। ১৯৯৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক স্কুল সিলেটে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। কিন্তু ২০০২ সালে এসে ব্রেন স্ট্রোক হলে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। অন্যদিকে স্কুল কর্তৃপক্ষ বিনা নোটিশে চাকরিচ্যুত করেন। দীর্ঘদিন পর সুস্থ হয়ে উঠলে পুনরায় লেখালেখি শুরু করেন। বর্তমানে নেত্রকোনা জেলা বারহাট্টা উপজেলা তেঘরিয়া বাজারে শাপলাকুঁড়ি বিদ্যানিকেতনে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থ ‘মহাসঙ্গমে’ ২০২০, ‘সিলেট ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা’ ২০০২ খ্রি.।