জুলি রহমান গুণী পরিবারের মেয়ে। মা ছবি আঁকেন। বাবা পুঁথি পড়েন। বড় ভাই কবিতার বাগান-মালি। আর সেজো ভাই বাউল। কাজিনদের একজন গানের কথার ফুলঝুরি ছড়াতেন অষ্টপ্রহর। সেই সূত্রে তিনি পেয়েছেন সৃজনশীল জগতের একজন হওয়ার যোগ্যতা। সেই যোগ্যতা আরো সুতীব্র করেছে বালিকাবেলার স্মৃতিবিজড়িত চাপিল গাঁয়ের মুন্সীবাড়ির অর্গল ভেদ করা উদোম আকাশকে বুকে ধারণ করে বয়ে যাওয়া ছোট্ট নদী কলমাই। তারই উজান-ভাটির স্রোতে নিজেকে সোপর্দ করে গান-কবিতার সুরে বাউলা হয়ে যান কবি। কবির মুখে তখন থেকেই শব্দকথার খই ফুটে ফুটে ছড়িয়ে পড়তে থাকে তার সাহিত্য বাগানে। জন্মগ্রাম চাপিল, শৈশবের কলমাই নদী, তারুণ্যের নগরজীবন, অতঃপর প্রবাস- সব মিলিয়ে কবি জুলি রহমান কবি হয়ে উঠেছেন এবং জীবনের কাব্যযাত্রার পথপরিক্রমায় তার সৃজনশীল ভাÐারে জমা হয়েছে ছয়-ছয়টি কাব্যগ্রন্থ। অর্জনকাল ২০০৫ থেকে ২০১৪। সেই সব কাব্যগ্রন্থের যুথবদ্ধ কর্মই আলোচ্য ‘জুলি রহমানের কবিতা’। দেওয়ান আতিকুর রহমানের কাব্যিক প্রচ্ছদে প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার সুদীর্ঘ কলেবরের ছয়টি কাব্যগ্রন্থের সমষ্টি ‘জুলি রহমানের কবিতা’ প্রকাশ করেছে রুচীশীল প্রকাশনা সংস্থা সাহিত্যদেশ। প্রকাশকাল ২০১৬। মূল্য ৫৫০ টাকা। স্বদেশ ও ভিনদেশের কাব্যময় ভুবন পরিভ্রমণের সরলচিত্র সংবলিত ৪০০ কবিতার আশ্রয় মিলেছে ‘জুলি রহমানের কবিতা’য়। কাব্যগ্রন্থে আশ্রিত কবিতাগুলো নিদারুণ কাব্যিক নিপুণতার সঙ্গে কবি অতি সহজেই স্বদেশের নদ-নদী, ফুল, ফল, প্রকৃতি এবং যাপিত জীবনের সঙ্গে প্রবাসের মিলন ঘটিয়েছেন। আর তাই ‘স্থান কালের সীমারেখায় কবি আবদ্ধ নন’- এ বিশ্বাসই কবির ফুটে ওঠে অবলীলায় তার কাব্য-ক্যানভাসে। ‘ঝরা পাতা কথা বলে’ প্রকাশের কাল নেই। কারণটা বোধ করি- এটি বই আকারে প্রকাশ পায়নি। সে হিসাবে ‘ঝরা পাতা কথা বলে’ অংশটুকু জুলি রহমানের কাব্যভক্ত অনুরক্তদের জন্য একটি বাড়তি পাওনা বলাই যায়। অর্থাৎ ‘জুলি রহমানের কবিতা’য় শুধু তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থই নয়, অপ্রাকশিত কাব্যসম্ভারও যুক্ত হয়েছে। এবার আসা যাক কাব্যপাঠে। ‘ঝরা পাতা কথা বলে’ দিয়েই শুরু করি। ‘ঝরা পাতা কথা বলে’ সংকলন গ্রন্থটির বৃহৎ অংশ জুড়ে আছে- প্রায় দেড় শতাধিক পৃষ্ঠায়। ‘ঝরা পাতা কথা বলে’র সহজ পাঠ হচ্ছে- দেশ, কাল, পাত্র, যাপিত প্রবাসজীবন। খুব নিবিড় পাঠে জানা যাবে, কবি ‘ঝরা পাতা কথা বলে’তে স্বদেশের মানচিত্রে বাইরে এক টুকরো বাংলাদেশকেই ধারণ করে আছেন। সেখানে তার জন্মগ্রাম চাপিলের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী কলমাইয়ের পাশে আছে হাডসন নদী, ঝরা পাতার গাঁয়ের মতো আছে নিউ জার্সি ও ম্যানহাটানের বনপথ। ‘ঝরা পাতা কথা বলে’তে আমরা আরো খুঁজে পাই- মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া মোশারফের কথার পাশাপাশি গুন্টার গ্রাস, মীর্জা গালিব, প্রমিথিউস, মাদার তেরেসা, হিমেনেথ, পাবলো পিকাসো, পাবলো নেরুদা, রবীন্দ্রনাথসহ বরেণ্যদের কাব্যিক উপস্থিতি। ‘ঝরা পাতা কথা বলে’তে কবি ব্যথিত হন ‘বিজয় বাড়ি নেই’ বলে (পৃ. ১২৮)। তাই প্রবাসে পরবাসে লেখা তার ‘অসমাপ্ত বাণী’র দুটি পঙ্ক্তি আমাদের আশাবাদী করে তোলে- ‘একটি ঘরের ষোলো কোটি দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছি বত্রিশ কোটি চোখ’ গ্রন্থের এ অংশে কবি জুলিয়া রহমানের আধ্যাত্মিক চেতনারও স্ফুরণ ঘটতে দেখি। এ রকম একটি কবিতা ‘হে অহংকার তাপস’-এ কবি নিজেকেই ‘তাপসী রাবেয়া’ বলেছেন। জুলিয়া রহমানের কবিতার দ্বিতীয় আলোচ্য গ্রন্থ ‘অতন্দ্র প্রহরী’ (পৃ. ২৫৩-২৮৭)। এ অংশে কবি প্রথমেই স্মরণ করেছেন নাগরিক কবি শামসুর রহমানকে। তিনি কবিকে জানার প্রয়াস পেয়েছেন নিজেকে ‘আচেনা চড়–ই’ হিসেবে (পৃ. ২৫৫)। নাম কবিতা ‘অতন্দ্র প্রথিবী’তে কবির অবলোকনে আমরা উপমার গভীরে হারিয়ে যাই। এই কবিতায় তিনি মোহাবিষ্ট ভাষায় বলেন, ‘বয়সের বৈঠা হাতে পৃথিবী হাটে দিবসের বুকে’ (পৃ. ২৭৬)। ‘চোখ পাথর নদী’ অংশের কবিতাগুলোকে আমরা বলব সুখপাঠ্য ৫৯টি অণুকাব্যসহ ‘মেঘ’ ও ‘লতা’ শিরোনামের দুটি কবিতার অনবদ্য নির্বাচিত সংকলন। ৫৯টি অণুুকাব্যের মধ্যে তিনি বক্তব্যধর্মী ৫৮ নং কাব্য কথায় বলেছেন জ্ঞান বিকাশের কথা। কবির জীবনচরিত অনুসন্ধানে যত দূর জানা যায়, তিনি শিক্ষকতার মতো মহান পেশায়ও নিযুক্ত ছিলেন। তাই তিনি ৫৮ নং কবিতায় বলতে পেরেছেন ‘খাদ্য প্রাণহীন খাবার যেমন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর/ জ্ঞানহীন শিক্ষা তেমন অশিক্ষার নামান্তর (পৃ. ৩১৬)। পৌরাণিক চরিত্র কাদম্বিনীর সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে সুখপাঠ্য কবিতাটি কবির অপূর্ব সব সৃজনের একটি মহৎ কবিতা। উদ্ধৃতি : ‘যুগ যুগ ধরে অনার্য সাঁতার কেটে কাদাসহ জলমাটির পরশমথিত চরাতে জেগে ওঠে হীরের মাটি’। (পৃ. ৩০৫) জুলি রহমানের কবিতা শীর্ষক কাব্য সংকলনের সমগ্র কাব্য বিবেচনায় ‘তোমাকে দেখব বলে’ কাব্যগ্রন্থটি প্রথমে সংযোজনের মাহাত্ম্য যথার্থ বিবেচনাপ্রসূত। ২০১৪ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থটির প্রথম কবিতাটি নাম ‘ হারিয়ে যাওয়া মাকে’ উৎসর্গকৃত কাব্যগ্রন্থটিতে কবি এমনভাবে তাকে উপস্থাপন করেছেন যেখানে সেই মা হয়ে উঠেছেন আমাদেরই চিরচেনা বাংলার মা। এখানে আরেকটি বিষয়- কবির অনুশোচনা বোধ, স্মরণবোধ যা কবিকে যোগ্য সন্তানের পরিচয় দিয়েছে। কবি যেন প্রবাসে এসে ‘দেশ-মা’কে হারিয়ে শেষে তার আপন মাকেও হারিয়ে ফেলেছেন। কবিতাংশ- ‘ধীরে ধীরে আড়াল হলাম মা, মাটির, দেশের সেই, শেষ দৃশ্য ভাবিনি তখনো আর তোমাকে দেখতে পাবো না।’ (পৃ. ১৬) ‘তোমাকে দেখব বলে’ কাব্যগ্রন্থে যথারীতিতে প্রবাস আছেই যেখানে ‘ওয়াটার ব্যারিতে সন্ধ্যা নামে’ (পৃ. ১৭) এবং পায়ের তলায় ম্যানহাটান সিটি উদোম আকাশ (বৃষ্টি ফোঁটার গান, পৃ. ১৮) দেখা যায়। মুক্তিযুদ্ধ আছে স্বাধীনতা না-বোঝা গেদু মাঝির করুণ চিত্রে। কারণ ৯ মাস পর বাড়ি ফিরে আর্তচিৎকারে বলে- ‘কই গেলি বৌ? আমার হইলদা পাখিটা?’ (পৃ. ৩৪) তাই কবির মতো আমরাও বলি- আমি এখনো কেন স্বাধীনতাকে খুঁজি? (পৃ. ৩৯)। ‘জুলি রহমানের কবিতা’ গ্রন্থের আলোচনার পরিসমাপ্তিতে কবির ছয়টি কাব্যগ্রন্থের নিরিখে পাঠক কবিকে খুঁজে পাবেন প্রকৃতিপ্রেমী, পর্যটনপ্রেমী, স্বদেশপ্রেমী এক দরদি কবিকেই।
জুলি রহমান মূলত কবি। ছেলেবেলার গান কবিতা মুড়ি-মুড়কির মতো উড়িয়ে দিতে দিতে কখন তা চলে এলো কলমের নিপুণ ডগায় তা হলফ করে বলাই মুশকিল। বস্তুত তারই দীঘল মাঠে আজো রয়েছেন তিনি কানায় কানায় পূর্ণ; সৃষ্ট কাব্যবাণী মাত্রার অভোগী প্রত্যয়ী হয়ে। তবে তিনি শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই ছিলেন মেধাবী। স্কুল কলেজে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ম্যাগাজিন, দেয়ালিকায় তার ভূমিকা মেজাজি, মেধাবী। শিক্ষা জীবন: ঢাকা পলিটেকনিক স্কুল, লালমাটিয়া কলেজ, তিতুমীর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ করেন। স্বামী তখন প্রবাসী। তবে তার কচ্ছপী চলা বিরামহীন। শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি টেনে একসময় স্বামী সংসারের মোহে সুদূর মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমান। কবি জুলি রহমান ধামরাই থানার চাপিল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম তজিম উদ্দিন মাতা ফাতেমা খাতুনের পঞ্চম সন্তান। পেশায় শিক্ষিকা জুলি রহমান একই সময় শিক্ষকতা ও শিল্প সাহিত্যচর্চার নিষ্ঠাত্রিপর্ণ প্রভায় তিনি হয়ে ওঠেন কাব্যকথা শিল্পবোধের সরসী মুকুর। সাহিত্যের নানা শাখা প্রশাখার চর্চাবর্তে তিনি নিজেকে করে চলেছেন পরিব্যাপ্ত। যার ফলশ্রæতিতে তার সৃষ্টি সৌকর্যে রূপায়িত হয়ে চলেছে সময়ের গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নিবন্ধসহ গান গীতিকাব্য গীতিনাট্য ও পুঁথি! বাবার পুঁথিকে ধরে রাখার জন্যই তার প্রয়াস। বিবাহ পূর্বে তিনি দীর্ঘকাল ঢাকায় বিভিন্ন সাহিত্য সভাসহ পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি। স্বামীর সঙ্গে সুদূর মধ্যপ্রাচ্যে একটানা দশ বছর সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অদম্য কাজ করেন। ধারাবাহিক উপন্যাস ‘যুদ্ধ ও নারী’, ‘বহে রক্তধারা’, ‘ব্যবধান’, ‘ফাতেমার জীবন’, ‘একজন দলিলুর রহমান’ ইত্যাদি সত্যের আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হয় গল্প-কবিতা রিয়াদ ডেইলিতে। রাইটার্সসহ জাগরণ রূপসি চাঁদপুর, ইত্যাদি লিটলম্যাগেও। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি সম্পাদনা করেন মধ্যপ্রাচ্যে ‘জলপ্রপাত’, ‘অনিবাস’, ‘রৌদ্দুরের’। কবির প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা সেই বিচারে প্রচুর নয়। মাত্র ২৫টি। তার উপন্যাস ও গল্প সমগ্র মুক্তির আকুতিতে অপেক্ষার ঘোলাজলে তর্পায়। কবিতা সমগ্র প্রস্তুতি পর্ব চলছে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৯শে প্রকাশ হচ্ছে ‘আয়নার যুদ্ধ’। এটি গীতিকাব্য। এ গ্রন্থের গীতিকাব্যগুলো সময়োপযোগী। স্বাধীনতার, বিজয়ের, বাংলা ভাষার, বৈশাখের, আমেরিকান কালচার বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের থ্যাংক্সগিভিং, সিক্সফ্লাগ্স, বাংলার শ্বাশ্বত চিরায়ত প্রেমের গীতিকাব্য নিয়ে ‘আয়নার যুদ্ধ’ বই। এই বইটির নামকরণে যিনি তিনি লেখকের বন্ধু আলেয়া চৌধুরী। জুলি রহমানের আরও প্রচুর গীতিকাব্য ও গান আছে, যা সংখ্যাতিত। যা এখনো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। বর্তমানে তিনি সাজুফতা সাহিত্যক্লাবের পরিচালক এবং সাজুফতা নামে সাহিত্য-কাগজও সম্পাদনা করেন।