কবি জাহানারা বুলা পাখির রং আবিষ্কার করেন ধূসররূপে। জীবনানন্দের পাÐুলিপির রং ধূসর। বিশ শতকে যে রাজনৈতিক দোলাচল মধ্যবিত্ত জীবনকে সঙ্কটাপন্ন করে তুলেছিল আজো তা’ বিদ্যমান। বরং নয়া উপনিবেশ, মুক্তবাজার অর্থনীতি, সমাজতন্ত্রের অনগ্রসরতা আমাদের তৃতীয় দুনিয়ার কবিদের ভাবনাকে প্রভাবিত করেছে অনিবার্য যন্ত্রণায়। জাহানারা বুলা একুশ শতকের কবি কিন্তু তার শেকড় পূর্বসূরিদের কাব্যপ্রবাহের সঙ্গে সংযুক্ত। আধুনিকতাবাদীরা রোমান্টিকতা ও আবেগের মুক্তি চেয়েছিলেন। তারা যুক্তি ও আবেগের শাসন থেকে উৎসারিত হতে অদম্য প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। টি এস এলিয়ট, ডবিøউ বি ইয়েটস প্রমুখরা ধূসর পৃথিবীর রূপ আবিষ্কার করেছিলেন মর্মন্তুদ কাব্যভাষায়। নজরুল যেমন বলেছিলেনÑ‘প্রেম দিতে এসেছিলাম প্রেম পেতে এসেছিলাম, সে প্রেম পেলাম না বলে নীরব অভিমানে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলাম।’ জাহানারা বুলার কণ্ঠস্বরে সেই আত্মাভিমানের জায়গা প্রবল। ‘বৈরাগ্য ব্যথা’ কবিতায় তিনি যেমন বলেনÑ ‘আঙুল ছোঁয়াতে কেন এলে আবার বেদনায়? ভালোবাসো না সেতো বহুকাল! সেই ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকা যেন এক ভয়ানক বৈরাগ্য ব্যথা।’ ব্যথা বৈরাগ্যে রূপ নিয়েছে। কবি সংসারী কিন্তু তার হৃদয় বৈরাগ্যে বিভাজিত। সংসারের দায় থেকে কবিরও মুক্তি নেই। কিন্তু মন তো স্বাধীন, সে ডানা মেলে চলে যায়Ñ‘সিংহল সমুদ্র থেকে নিশিমের অন্ধকার মালয় সাগরে’। এই পর্যটন অপ্রতিহত। জাহানারা বুলা মুগ্ধ সহজ ও আন্তরিক উচ্চারণে তার কাব্যভাবনা পাঠকের হৃদয়ে সঞ্চারিত করেন। নাগরিক কিন্তু নিঃসঙ্গ, সামাজিক কিন্তু স্বাপ্নিক, দ্রোহী কিন্তু গভীরতাগামী। জাহানারা বুলার কাব্য বৈশ্বিক রোমান্টিক ধারারই অনুবর্তন। তার বেদনা, প্রেম-হতাশা, পরাজয়, গøানি ও বিজয় সবকিছু শিল্পমানে সমাবৃত। ধূসর থেকে উজ্জ্বলতায় উত্তরণের আকাক্সক্ষা তাকেও উৎব্যস্ত রাখে। কিন্তু সেই আলো নীল ভেঙে সবুজ, সবুজ থেকে সাদায় অন্তর্হিত। নির্বাণকামী এই কবির মুক্তি আত্মউন্মোচনে আত্মআবিস্কারে। তাঁর পথচলা হোক অপ্রতিহত। রেজাউদ্দিন স্টালিন
জন্ম ১২ নভেম্বর ১৯৬৩, নারায়ণগঞ্জ জেলায় | বাবা আবদুল কাদের মিয়া, মা নূরুন্নাহার বেগম। ডানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স এবং মাস্টার্স শেষ করে। সংসার জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন জাহানারা ঝুলা। তাঁর কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা স্বল্প সময়ের। সংসার জীবনের পাশাপাশি তিনি কিছুদিন একটি বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেন। এরপর ছেলেমেয়ের উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যান সুদূর কানাডায়। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া শেষ হলে জাহানারা বুলা ঢাকায় ফিরে আসেন এবং বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল টিউটোরিয়াল (BIT) নামে উচ্চমানের একটি ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে বাংলার শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। বিশেষ প্রয়োজনে কাজ থেকে অব্যাহতি নিয়ে তিনি আবার চলে যান কানাডায়। এভাবে বারবার যাতায়াতের কারণে এবং সংসার-সন্তান-স্বামীর প্রতি গভীর মনোযোগের কারণে স্থির হয়ে পেশায় যুক্ত থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। শিল্প সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁর আগ্রহ থাকলেও সন্তান-সংসার-স্বামীর প্রতি অধিকতর কর্তব্যের পাশাপাশি খুব একটা মনোযোগ তিনি দিতে পারেননি অন্য কোনো কাজেই। সন্তানরা মোটামুটি একটা পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার পর ২০১২ সাল থেকে তিনি লেখালেখিতে অল্পবিস্তর মনোযোগ দিতে পেরেছেন। এখনো নিরবচ্ছিন্ন সময় তিনি লেখার কাজে ব্যয় করতে পারেন না। সংসারের ফাঁকেফাঁকে সাহিত্য চর্চা করেন। ভালো কিছু লিখতে চাওয়ার সময়টুকুই এখন তাঁর কাছে বেশি আনন্দের। বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন, সংকলন, ওপার বাংলার ম্যাগাজিন, শিশু এক্সডেমি, বাংলা এক্সডেমি এবং কানাডার টরন্টো ভিত্তিক প্রায় সবগুলো বাংলা পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। জাহানারা বুলা দুই সন্তানের জননী। প্রথমটি কন্যা সন্তান এবং দ্বিতীয়টি পুত্র। তাঁর কন্যা তাসমিয়া তাবাস্সুম কানাডায় 'ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টো' থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উপর গ্র্যাজুয়েশন, মাস্টার্স শেষ করে এখন পিএইচডি করছে। তাঁর পুত্র তওসিফ মুহান্তের কানাডার 'ইয়র্ক' ইউনিভার্সিটি থেকে পড়া শেষ করে এখন ঢাকায় মাস্ক কমিউনিকেশনের উপর পড়াশোনা করছে। সে একজন প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার এবং গিটারিস্ট। জাহানারা বুলার স্বামী মুস্তাফিজুর রহমান একজন সফল ব্যবসায়ী। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থঃ যদি আরো কারে ভালোবাসো (উপন্যাস-সিঁড়ি প্রকাশন), ফিরে চলো নিরুপমা (উপন্যাস-বলাকা প্রকাশন), পুতুল বিয়ে (শিশুতোষ ছড়া-শুদ্ধস্বর), তুশি বাংলা বলতে পারে না (শিশুতোষ গল্প-জিনিয়াস পাবলিকেশন্স), কষ্টে জমা জল (কাব্যগ্রন্থ-সূচিপত্র), পারিজাতের কেশর (কাব্যগ্রন্থ-সূচিপত্র), কবিতার মত ঠোঁট ছুঁয়ে থাকো তো (কাব্যগ্রন্থ-বলাকা প্রকাশন), ধূসর রঙের পাখি (কাব্যগ্রন্থ-মহাকাল), আলোহীন অন্ধকারে (কাব্যগ্রন্থ-মহাকাল)।