সময় থেমে থাকে না। জীবনও না। কিন্তু এই গতিময়তার সঙ্গে সঙ্গে চক্রাকারে ইতিহাস তার নিজস্ব বার্তা রেখে যায়। সে ফিরে ফিরে তার সত্যোচ্চারণ করে। অমোঘ সত্যের পক্ষেই বারবার অবস্থান নেয়। শাসকের চাওয়া না চাওয়ায় সে পথের বা সে মতের অবস্থান কোনদিন থমকে থাকে না। বদলায়ও না। রাজনীতির গতি প্রকৃতি বরাবরই দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে সবশেষে। হয়তো নানা বিভ্রান্তির মোড়ক প্রকৃত মতকে খাঁচায় বন্দি করে রাখে। কবির ভাষায় বলতে হয় এ অবস্থা চলতে থাকে তিষ্ঠ ক্ষণকাল। নানা উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে অবস্থা বদলায়। বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলনসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাই দেখা গেছে। একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর প্রকৃত ঘটনা তার স্বরূপ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। আমজনতা বিভ্রান্তি কাটিয়ে সত্যের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। নূরে আলম সিদ্দিকী। এই নামটি নিয়ে বাড়তি বলার কিছু নেই। যিনি স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি বাঁক বদলের ঘটনাপ্রবাহের অন্তরে ছিলেন। হৃদয়ের গভীরে যিনি ছক কেটেছিলেন বাংলার মানুষের মুক্তি আন্দোলনের। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন একাত্তরে বাংলার মানুষের মুক্তি আন্দোলনে। যার কণ্ঠনিসৃত বাণী বাংলার কৃষক শ্রমিক ছাত্র জনতার প্রেরণা ছিল বরাবরই। সেই তিনি চলমান সময় ও ঘটনাপ্রবাহ নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে তুলে এনেছেন বুব্ধিবৃত্তির ফলায়। প্রায় দু ডজন লেখায় তিনি স্পষ্ট উচ্চারণে প্রতিভাত করেছেন চলমান সময়কে। লেখার শিরোনামগুলো আমাদের এক নজরে জানান দেয় তিনি কি বলতে চেয়েছেন। ‘সংবাদপত্র, সাংবাদিকতা ও আমাদের প্রত্যাশা’, ‘গণতন্ত্র নাই, গণতান্ত্রিক আন্দোলনও নাই’, ‘কে এই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করবে?’, ‘রাজনীতিতে সহিষ্ণুতার বড় অভাব’, ‘তারুণ্যই অপশক্তিকে পরাজিত করতে পারে’, ‘দুর্নীতি করোনা ভাইরাসের চেয়েও সর্বনাশা’ ‘শেখ মুজিব স্বাধীনতার প্রতিশব্দ’, ‘বিশ^মানবতা জাগ্রত হোক’, ‘নেতৃত্বে সৃজনশীলতা আনা জরুরি’। লেখাগুলো প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, দৈনিক মানবজমিন এবং দৈনিক বণিক বার্তায়। নিবন্ধগুলো প্রকাশের পরপরই নানা মহলে আলোচনা হয়েছে স্পষ্ট উক্তি হিসাবে। তারই ধারাবাহিকতায় এবারের বইমেলায় লেখাগুলো বই আকারে কারুবাক প্রকাশনী থেকে একমলাটে প্রকাশিত হলো।
তিনি বিগত শতাব্দীর ষাট দশকের এক অনবদ্য সংগ্রামী পুরুষ। ঐ দশকের অগ্নিঝরা দিনগুলিতে ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী তুর্কি তাজির মতো ক্ষুরের দাপটে মেদিনী কাঁপিয়েছেন। জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান, দৈনিক ইত্তেফাকের কালজয়ী সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের স্নেহাস্পর্শে গণতন্ত্র, অসম্প্রদায়িকতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদভিত্তিক চেতনায় বেড়ে উঠেছেন তিনি। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক মতাদর্শ তাঁর রাজনৈতিক জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। ছয় দফা আন্দোলনের প্রথম শহীদ মনু মিয়ার রক্তাক্ত জামা নিয়ে ’৬৬-এর ৭ জুন ঢাকায় আইউববিরোধী মিছিলের নেতৃত্বদানের মধ্য দিয়ে এ দেশের রাজনীতিতে একজন বলিষ্ঠ ও সুযোগ্য ছাত্রনেতা হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৭০-এর নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের তদানীন্তন সভাপতি হিসেবে তিনি যে সাহস, বুদ্ধিমত্তা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার স্বাক্ষর রেখেছেন, তা এদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বলতম অধ্যায় হয়ে রয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৭১-এর ১ মার্চ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হওয়ার মুহূর্ত থেকে স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতা-উত্তরকালে স্বাধীনবাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সব সভায় সভাপতিত্ব করার একক গৌরব তাঁর। ২৩ মার্চ ১৯৭১-এ প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলনের সময় স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃ চতুষ্টয় আনুষ্ঠানিক অভিবাদন গ্রহণ করার পর সেই পতাকাটি তিনি সগৌরবে বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেন। তিনি আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। বঙ্গবন্ধুর অন্যতম বিশ্বস্ত কর্মী হিসেবে আজও তিনি বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শ-ত্যাগ এবং নেতৃত্বের বিশ্বস্ত অনুসারী হিসেবে নিজেকে অবিচল অবস্থানে ধরে রেখেছেন। দেশে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আজ যে কক্ষচ্যুতি, পথভ্রষ্টতা, স্বার্থমগ্নতা এবং নিজ হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার দূষিত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, নূরে আলম সিদ্দিকী তাতে বিচলিতবোধ করেন। বৃহত্তর যশোরের ঝিনাইদহে ১৯৪৪-এর ২৬ মে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা নূরনবী সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মানিক মিয়ার ঘনিষ্ঠতা অর্জন করেছিলেন। ১৯৬৬-এর জুনে ছয় দফার পক্ষে আয়োজিত হরতালে বলিষ্ঠ নেতৃত্বদানের অভিযোগে তিনি গ্রেপ্তার হন। অতঃপর ১৭ মাস কারান্তরালে থাকাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেন এবং ঐ বন্দিদশায়ই তিনি স্নেহময়ী জননী নূরুন নাহার সিদ্দিকীকে হারান। কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে থাকা অবস্থায় তিনি বাংলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসশাস্ত্রে ট্রিপল এমএ ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৭০ সালে আইনশাস্ত্রেও উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণের পর সামরিক বাহিনীর হাতে বন্দি অবস্থায় নির্যাতন, লাঞ্ছনা ও শত অপমানে জর্জরিত হয়েছেন; প্রতিনিয়ত মৃত্যুর প্রহর গুনতে হয়েছে তাঁকে। বর্তমানে তিনি ডরিন গ্রুপের চেয়ারম্যান। তিনি সাবেক সাংসদ এবং প্রাক্তন ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের আহ্বায়কও। প্রকাশিত গ্রন্থ ৫টি : ‘একাত্তরের অজানা কাহিনী: এক খলিফার বয়ান’, ‘আওয়ামী লীগ বিরোধী নই, তবুও সমালোচনা করি’, ‘কালের কলধ্বনি’, ‘সংঘাত সংশয় সাফল্য’ ও ‘ইতিহাস একদিন কথা বলবেই’।