"আমার সঙ্গে থাকিয়ো আঙ্গুরি আমার হিমবাহে বা হেমলোকে" বইয়ের সংক্ষিপ্ত কথা: ‘কবিতার কোন রূপ, কোন রঙ— মনশ্চক্ষুর রেটিনার রডস্ ও কোনস্-এ শুদ্ধভাবে প্রতিবিম্বিত হবে, কোন রেখাবের সুর অনুরণিত হবে চৈতন্যের সেতারের তানে ও ঐকতানে— কে জানে? কে বলতে পারে? যা লেখা হল তা নিতান্ত অবাচ্য হতে পারে, হতে পারে অজ্ঞাতকুলশীল, অথবা তার কোনো পঙ্ক্তির অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমা ছুঁয়ে ফেলতে পারে মহাকালের সীমারেখাকে : হয়তো এখন, অথবা শতবর্ষ পরে। এটাই চিরন্তন। কবি যা লেখেন, বা যা লিখতে চান— তা সকল বা সাধারণ্যের ভাবনার বেতারে সুললিত হয়ে না-ও উঠতে পারে, বা বিপ্লুত হতে পারে আসমুদ্রহিমাচলে, কবি তা জেনে ও বুঝেই লেখেন। অথবা জানতে চান না, বুঝতেও চান না। কবি নিষ্কামভাবেই লিখে চলেন। কবিতা তো বসেই লিখে ফেলার বিষয় নয়। কবিতা অন্তর্গত অধরা মাধুরীর সিঞ্চিত এক রূপ যাকে মূর্তির আদলে শব্দ ও আবেগ দিয়ে ছেনেছুনে তৈরি করেন কবি এক নিরুপম প্রতিমা। সকলেই তো তেমন ভাস্কর হয়ে উঠতে পারেন না, তবে সকলের ভাস্কর্যই কিছু একটা বলতে চায়, কিছুকে অবাঙমানসগোচর থেকে অবমুক্ত করতে চায়, আবার কখনো-বা খোলা হাওয়ার ঘূর্ণিকে বেঁধে রাখতে চায় অনচ্ছ বোতলে শোলার ছিপি দিয়ে ঢেকে। আমিও তা-ই করতে চেয়েছি। আমার চংক্রমিত ভাবনার অনুনাদকে আমি ধরতে চেয়েছি সহজিয়া সুরে, কখনো-বা ধ্রুপদ খেয়ালে। এই সুর সকলের তন্ত্রীতে মোহন ধ্বনি তুলে বাজবে, তেমন দুঃসাহস আমি করি না। তবে কাবুলিওয়ালার মতো ‘দই আছে গো, দই; ভালো দ...ই’— বলে বাড়ি বাড়ি হাঁক দেওয়ার পর কোনো এক অচেনা অমল-এর উৎসুক চাহনিকে যদি একটিবারও ভাঁড়ভর্তি দইয়ের হাঁড়ির দিকে ফেরাতে পারি, তবেই আমার অনঙ্গ তৃপ্তি। আমি কাবুলিওয়ালা হয়ে বের হলাম কোনো এক হৃদয়কাড়া অমল-এর অপেক্ষায়... ... ...।’ “এই বইয়ের বেশিরভাগ পঙ্ক্তিই ছন্দোবদ্ধ। ছন্দের ভেতরেই কখনো কখনো কবন্ধ হয়ে উঠেছে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ, কখনো-বা গন্ধরাজের সুগন্ধকে ডানায় মেখে আবেগ ও উদ্বেগের সাদা বিহঙ্গেরা উড়ে গেছে দুদ্দাড় নিঃসীম শূন্যে, অথবা এই ছন্দকে ঘিরে মৃদুমন্দ হাওয়ায় দোল খেতে খেতে টুপ করে ঝরে পড়েছে গাছের ছোট্ট পাতার মতো ভাবনার সৌকর্যসমূহ, আবার প্রেমের ‘অতুল্যতেজ’ সময়গময় ছাড়াই ঠিকরে পড়েছে বেশ কটি কবিতার গমকে ও ঠমকে। আছে ছন্দহীন লিরিকে লেখা প্রচল শব্দাবলি, যা বানের জলের মতো গতিময়তায় ছুট্টে গেছে দিগন্তরেখার ওপারে, কখনো প্রিয়তমার অবোধ্য সাহচর্য অথবা ওমের আশায়; কখনো নিরন্ন বিরহে নাগা-সন্ন্যাসীর মতো বিবস্ত্র হয়ে। তাই এর পাঠ কোথাও কোথাও ধীশক্তিসহ খানিকটা তিষ্ঠোবার কামনা করে, আবার কোথাও-বা এর সহজাত চলন কায়ক্লেশকে অগ্রাহ্য করে পুরোদমে। পড়লেই বোঝা যায় সব, আবার নিবিষ্টতাকেও যাচ্ঞা করে অনেক ক্ষেত্রেই। পাঠকের মন তা আস্বাদন করুক অজানা সভ্যতার চকিত আবিষ্কারের মতন, অথবা আবিষ্কৃত পুরাতত্ত্বের নিখুঁত বীক্ষণকে বিজাড়িত করে।”