‘নিজের জীবদ্দশায় মির্জাকেও কবিতার বইয়ের এমন ভূমিকা লেখার ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। মির্জার প্রিয় শিষ্য ছিলেন মুনশি হরগোপাল। তুফতা নামে তিনি কবিতা লিখতেন। ফারসি কবিতা। রইস লোক। বয়স কম। মনে আবেগের জোয়ার চলছে হরহামেশা। ফলে লিখতেন দেদার। প্রতি বছর ঢাউস আকারের কবিতার বই ছাপতেন। আর ফি বছর সেই বইয়ের ভূমিকা লেখার দায় পড়ত মির্জা গালিবের ওপর। এক বছর সেই ভূমিকা লিখতে পারলেন না। তুফতা অভিমান করলেন। গালিব চিঠিতে তুফতাকে লিখলেন: প্রতি বছর তুমি ঢাউস বই বের করবে! আমি আর কত ভূমিকা লিখব? খোদা আমার রোজা নামাজ মাফ করে দিলেন, তুমি কি আমার ভূমিকা লেখার দায় মাফ করবে না?
মির্জার প্রতি অনুরক্তির চল অনেক দিনের। বেঁচে থাকতে প্রতিষ্ঠানের হাতে নাজেহাল হয়েছেন। কিন্তু তরুণ প্রজন্মের কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় মানুষ। তাঁর কাছেই ছিল অনাগত যুগের চাবি এটা তরুণেরা বুঝতে পেরেছিলেন। নতুন ভারতবর্ষের ভাষা কণ্ঠ পেয়েছিল গালিবের জবান অনুসরণ করে। মৃত্যুর পর তাঁর অনুরাগীদের হাতেই কবিতা আর ভাবনার হাল ঠাঁই পেয়েছিল। গালিবের কমবয়সী শিষ্য আলতাফ হুসেইন হালি ‘মুকাদ্দামায়ে শের ও শায়েরি’ [কবিতা ও কাব্য প্রসঙ্গে] লিখে ভারতবর্ষে আধুনিক কাব্যভাবনার সূত্রপাত ঘটানোর অন্যতম হলেন। আর কিছুদিন পর এমন অবস্থা হল যে উর্দু ভাষায় অসংখ্য কবিতা গালিবের নামে চালু হয়ে গেল। অনামা কবিরা বিনা দ্বিধায় কবিখ্যাতির মোহ ছেড়ে নিজেদের কবিতা গালিবের নামে চালু হতে দিচ্ছেন আজও।
গালিবের ছিল দুইজন বিশ্বস্ত পরিচারক। একজন কল্লন বা কাল্লু। আরেকজন ওয়াফাদার। হাল আমলের খ্যাতনামা কবি, গীতিকার গুলজার বলেন যে, ‘গালিবের এই দুইজন পরিচারক মরে মুক্তি পেয়েছে, তাঁর তৃতীয় পরিচারক আমি এখনও তাঁর গোলামি করে যাচ্ছি’। দেখতে পাচ্ছি বাংলা ভাষাতেও একজন নিতান্ত কমবয়সী কবি গালিবের গোলামী স্বীকার করে নিয়েছেন। মাসুদ পারভেজকে এই মর্যাদাকর পদে স্বাগত! পূর্ব বাংলায় গালিবকে নিয়ে সংযোগ গড়ে উঠেছিল গালিবের জীবদ্দশাতেই। ঢাকার নবাব পরিবারের একজন উর্দু কবি ছিলেন খাজা আব্দুল গাফফার আখতার। তিনি নিজের কবিতার সূক্ষ্মতা প্রমাণ করতে গিয়ে এক গজলের শেষ পঙক্তিতে লিখেছিলেন— গালিবও স্বীকৃতি দেবেন তোমার ভাষা শৈলির নিয়ে এই গজল আখতার যখন যাবে দিল্লি [দাদ গালিব ভি তুঝে দেংগে যুবাঁ দানি কি লে কে আখতার জো য়ে দিল্লি মেঁ গজল জায়েগা]
আবু হেনা মোস্তাফা কামাল গালিবের সাহস তাঁর নিজের নেই বলে আক্ষেপ করেছেন—সত্য গঙ্গোপাধ্যায় ১৯৫৯ সালে চুঁচুড়া থেকে মীর তকি মীরের জীবনী, কবিতা ও কাব্য আলোচনা নিয়ে একটি পরিশ্রমী ও বেশ বিস্তৃত গ্রন্থ প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন যে এর আগেই তিনি গালিব, জাফর ও ইকবাল নিয়ে বই ছেপে বের করেছেন। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য মতে তিনিই বাংলা ভাষায় গালিবের প্রথম অনুবাদক ও আলোচক। ১৯৬৭ সালে বাংলা পত্রিকা ‘মাহে নও’-এ রশিদ ফারুকি গালিবের জীবন ও কাব্য নিয়ে বিস্তৃত প্রবন্ধ ছাপেন। ১৯৭৬ সালে আবু সয়ীদ আইউব তাঁর বিখ্যাত ‘গালিবের গজল থেকে’ প্রকাশ করেন। জনাব আইউবের নিজ মাতৃভাষা উর্দু, তাঁর পশ্চিমা-দর্শনের বিস্তৃত অধ্যয়ন, রবীন্দ্রকাব্যের নিখুঁত সমঝদারি এই বইকে ‘মূলধারার’ সমালোচক ও পাঠকমহলে সবচাইতে পরিচিতি দেয়। বাংলায় গালিব-আলোচনায় তিনি এখনও তুলনাহীন। এর পর অনেকে গালিবকে নিয়ে লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন। এর মাঝে বাংলাদেশের মনিরউদ্দিন ইউসুফ, ডক্টর মফিজউদ্দিন চৌধুরীর অনুবাদ উল্লেখযোগ্য। হাল আমলে শ্রীজাত গালিবের কবিতা কয়েকটি অনুবাদ করেছেন, সুর দিয়েছেন, গাইয়েছেন।
গালিবের ভাবনার চাইতে তাঁর অন্যরকম জীবনযাপন বাংলা কবিদের আকর্ষণ করেছে বেশি। যেমন আবু হেনা মোস্তফা কামালের এই কবিতাটি লক্ষ করুন— যখন তিনি থাকবেন না তখনো মেয়েরা অষ্টাদশী হবে, এই কথা ভেবে গালিব খুব কষ্ট পেয়েছিলেন ... গালিব আমার প্রিয় কবি এবং সেজন্য সবসময় বড় লজ্জার ভেতরে থাকি কেননা, আমি কখনোই তার মত সাহসী হতে পারব না। [গালিবের ইচ্ছা অনিচ্ছা] সমসাময়িক কালে সুমন সাজ্জাদ দিল্লিতে গিয়ে গালিবের সমাধি ঘুরে লিখেছেন— যদিও কাবাবঘর, মাংস-মসল্লা, ট্যুরিস্ট বাসে ভিড়, আড়ালে-আভাসে তার নীরব মুশায়রা—পুরনো দিল্লির ... বাতাসে কোথাও তবু এক টুকরো শের, ভাসে। গালিবের কবরের পাশে মৃত ফুল জ্যান্ত হয়ে আসে... [মির্জা গালিবের কবর] পূর্বজ ও অন্য ভাষার কবির প্রভাবে আরেক কবির সৃষ্টি কাজে ব্যাপৃত হবার অন্য রকম নজিরও আছে। গেটে ইরানি কবি হাফিজের গজলের অনুবাদ পড়ে এমন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন যে জীবনের শেষ ভাগে তিনি ‘প্রাচ্য-প্রতিচ্য দিওয়ান’ রচনা করেন। হাফিজকে তিনি বলতেন ‘দিব্য কবি’। বারো অধ্যায়ে গেটে পারস্য তথা হাফিজের আদলে দুইশ কবিতা লেখেন সৃষ্টির মাঝে পরম সত্যের প্রকাশ, সেই সত্যের বিস্মৃতি আর অনুসন্ধান নিয়ে।
গেটে তাঁর এই কবিতাগুলোতে বহু শত বছরের ব্যবধানে বাস করা দুই দেশের দুই সংস্কৃতিকে সংলাপে বসিয়েছিলেন। মাসুদ পারভেজ আজ মির্জা গালিবের সঙ্গে বাংলা ভাষার তেমন এক সংলাপের সম্ভাবনার কথা বলতে পেরেছেন। মির্জা গালিব আমাদের বিভক্ত, বিভাজিত উপনিবেশ পরবর্তী জাতি-রাষ্ট্রের অসাম্য-জর্জর সমাজে বিকল্প সম্ভাবনার কথা বলতে পারেন। যেমন সম্ভাবনা গেটে দেখতে পেয়েছিলেন ইরানের কবি হাফিজের মাঝে। এই সম্ভাবনার কথা বলতে পারার কৃতিত্বের স্বীকৃতি দিতেই এই ভূমিকা-লিখন সম্পন্ন হল। ’