ঠিক তেরো বছর বয়সে ডায়েরি লিখতে শুরু করেছিল এক সদ্যকিশোরী। তারপর দু বছর দু মাস। পনেরো বছর দু মাস বয়সী কিশোরী শেষ আঁচড় টেনেছিল ডায়েরির পাতায়। তার ঠিক সাত মাস পরে এই পৃথিবীর জল-মাটি-হাওয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছিল সেই কিশোরীর। অথবা হয় নি। রয়ে গেছে। রয়েই যাবে। সেই কিশোরীর সেই ডায়েরি, দু বছর দু মাসের দিনলিপি-আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি। বাবার নাম অটো ফ্রাঙ্ক, মায়ের নাম এডিথ। জার্মানির বাসিন্দা তাঁরা, ধর্মে ইহুদি। অটো-এডিথের প্রথম সন্তান মারগট, জন্ম তার ১৯২৬ সালে। দ্বিতীয় সন্তান আনা, আনা ফ্রাঙ্ক, জন্ম ১৯২৯ সালের ১২ জুন। ঠিক তখনই জার্মানির মাটিতে মাথা তুলছে হিটলার, সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে তার নাৎসি বাহিনী। ইহুদিদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছে তারা। অনেক ইহুদিই জার্মানির পাট চুকিয়ে চলে যাচ্ছেন অন্য কোনো দেশে, নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। ১৯৩৩ সালে দেশ ছাড়লেন অটো ফ্রাঙ্কও। চলে গেলেন হল্যান্ডে। আনা ফ্রাঙ্ক তখন চার বছরের শিশু। তার ছ’বছর পর শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। পৃথিবী দখলের স্বপ্ন দেখছে হিটলার। জার্মানি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনকে, কারণ তিনি ইহুদি।। হল্যান্ডের আলো-হাওয়ায় বড় হচ্ছে আনা ফ্রাঙ্ক। হল্যান্ডের নিরাপদ আশ্রয়ও আর নিরাপদ রইল না। ১৯৪১ সালে হিটলারের নাৎসি বাহিনী হল্যান্ড দখল করল। শুরু হলো ইহুদিদের ওপর অত্যাচার। অসংখ্য ইহুদিকে পাঠানো হলো বন্দিশিবিরে। ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে সমন এল অটো ফ্রাঙ্কের নামে। অর্থাৎ-হাতছানি দিল বন্দিশিবির। সে ডাকে সাড়া দিলেন না অটো ফ্রাঙ্ক। নিজেদের অফিস-বাড়ির পেছনদিকে এক গোপন আস্তানায় আশ্রয় নিলেন সপরিবারে। সঙ্গে রইল আর-একটি পরিবার। সাহায্য করলেন কয়েকজন বন্ধু। আনা ফ্রাঙ্ক তখন তেরো বছর এক মাসের সদ্যকিশোরী। তারপর পঁচিশটা মাস। পঁচিশ মাস পর, ১৯৪৪ সালের ৪ আগস্ট, গোপন আস্তানায় হানা দিয়েছিল নাৎসিবাহিনী, আটজন ‘ইহুদি’ মানুষকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল বন্দিশিবিরে। জার্মানির আউশভিৎস্ বন্দিশিবিরে ১৯৪৫ সালের ৬ জানুয়ারি মারা যান আনার মা। মারগট আর আনাকে পাঠানো হয় আরও দূরবর্তী বেরজেন-বেল্সেন বন্দীশিবিরে। ১৯৪৫-এর ফেব্রুয়ারির শেষদিকে অথবা মার্চের শুরুতে সেখানেই মারা যায় মারগট। আর মার্চ মাসেই, ওই বন্দীশিবিরেই শেষবারের মতো চোখ বুজেছিল পনেরো বছর ন মাসের সেই কিশোরীÑআনা ফ্রাঙ্ক। বন্দিশিবির থেকে ফিরতে পারেন নি ফান ডান পরিবারের তিনজন সদস্য এবং ডাঃ ডুসেল-ও। মৃত্যুর অন্ধকার থেকে ফিরে এসেছিল শুধু একজন : অটো ফ্রাঙ্ক। আর তখনই তাঁদের দুই শুভার্থী, এলি আর মিপ, তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিল লাল ডোরাকাটা মলাটের একটা ডায়েরি এবং আরও কিছু কাগজ-আনার লেখা। আনার দিনলিপি। আনার গল্প-উপন্যাস-স্মৃতিকথা। প্রকাশিত হয়েছিল সেই দিনলিপিÑএই ‘আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি।’ তারপর ইতিহাস। এক সদ্যকিশোরীর দিনলিপি অনূদিত হয়েছে পৃথিবীর প্রায় সব ভাষায়, তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র, মঞ্চস্থ হয়েছে নাটক। এই ডায়েরিতে প্রায়শই খুঁজে পাওয়া যাবে সত্যিই-কিশোরী আনাকে, পরক্ষণেই পাঠককে বিস্মিত করে সামনে এসে দাঁড়াবে আশ্চর্য-গভীর আনা ফ্রাঙ্ক। দৈনন্দিন বর্ণনার পাশাপাশি তেরো থেকে পনেরোর দিকে হেঁটে-চলা কিশোরী অনায়াসে কথা বলে গেছে দর্শন, ঈশ্বর, মানবচরিত্র নিয়ে, প্রেম-প্রকৃতি-জীবনবোধ নিয়ে। সেই সঙ্গেই ফুটে উঠেছে সমকালীন ইতিহাস, ইহুদিদের লাঞ্ছনা-যন্ত্রণা-সংগ্রাম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছবি। লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখত আনা, স্বপ্ন দেখত মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকার। বেঁচে থাকলে আজ তার বয়সে হতো সত্তর বছর। সে বেঁচে নেই। ঝরে গেছে কুঁড়িতেই। অথবা ঝরে নি, ঝরে না। অনেক অনেক সত্তর পেরিয়েও, বেঁচে থাকে তারাÑস্রষ্টারা। বেঁচে আছে আনা, মৃত্যুর পরেও, কারণ বেঁচে আছে তার দিনলিপি, আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরিÑযার মৃত্যু নেই।