সমুদ্রগর্ভে মালোকাই দ্বীপে কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্ত নর-নারীকে নির্বাসনে দেওয়া হতো। কেউ তাদের দেখবার ছিল না, ব্যাধি যন্ত্রণায়, দুঃখে তাদের জীবন শেষ হতো। চারিদিকে সমুদ্র, তার মাঝে আর্ত নর-নারী, বালক-বালিকা নিজেদের দুর্ভাগ্য ও আশাহীন, সান্ত¡নাহীন জীবন নিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় কাল কাটায়। তারা আল্লাহ্কে ডাকত না, তাদের কোনো ধর্মজীবন ছিল না। তারা নিরন্তর ব্যাধি যন্ত্রণায় হা-হুতাশ করতো, আর অদৃষ্টকে অভিশাপ দিত। যাদের জীবনে কোনো আশা নাই, যারা আত্মীয়-পরিজন হতে বিচ্ছিন্ন হয়েছে, যাদের কোনো সমাজ নাই, যাদের কেউ শ্রদ্ধা করবার নাই, যাদের দুঃখ-ব্যাথার কথা কেউ চিন্তা করে না–তাদের জীবন কত ভয়ানক, কত দুঃখময়, কত শোচনীয়! এই অভিশপ্ত ও নির্বাসিত নর-নারীর জন্য কার প্রাণ অস্থির হয়েছিল? তাদের দুঃখের জীবন কার প্রাণে চিন্তা সৃষ্টি করেছিল? কে এই নির্বাসিতদের মাঝে যেয়ে তাদের সেবা করবে? তাদিগকে সান্ত¡না দেবে? তাদেরকে আল্লাহ্ ও মহৎ জীবনের কথা শোনাবে? তারা যে অভিশপ্ত! কে যাবে সেই দুঃসহ ব্যাধির সংস্পর্শে? তাদের কাছে যাওয়ার অর্থ–নিজের জীবনের সকল আশা-ভরসা জলাঞ্জলি দেওয়া এবং প্রয়োজন হলে কুষ্ঠব্যাধিকে বরণ করে নেওয়া। দামিয়ান নামক এক যুবক বহুদিন হতে এই নির্বাসিতদের কথা চিন্তা করেছিলেন। এই সুন্দর আকাশ, এই আলো গন্ধভরা মানব-সমাজ, জীবনের সহস্র ভোগ-আকর্ষণ একদিকে, অন্যদিকে রোগপীড়িত নর-নারীর করুণ মুখ–আতুরের গগনবিদারী চিৎকার–আর সীমাহীন আঁধারে ব্যথিতের করুণ মুখেরই জয় হল। জীবনের সকল আশা-কামনাকে বিসর্জন দিয়ে যুবক দামিয়ান নির্বাসিত কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্তদের সেবার জন্য প্রস্তুত হলেন, বন্ধু প্রতিবেশীদের সমালোচনা, আত্মীয়-স্বজনের মিনতি তার সঙ্কল্পকে দমাতে পারলো না। দামিয়ান একদিন ফরাশি দেশের উপকূলকে শেষ নমস্কার করে একখানি বাইবেল আর একটা সাগরের মতো বিরাট আত্মা নিয়ে আর্তের সেবায় সমুদ্রপথে যাত্রা করলেন। আহা! বিরাট মনুষ্যত্ব! যে জীবন সহস্র ভোগের শিক্ষা দিয়ে উজ্জ্বল করে তোলা যেতো–সীমাহীন সুখ দিয়ে যাকে ভরে দেওয়া যেতো, তা এখন দুস্থ নর-নারীর চিৎকার ক্রন্দনের মাঝে ব্যয়িত হতে লাগলো। দামিয়ান পিতার মতো, মায়ের মতো, বন্ধুর মতো ব্যাধিগ্রস্ত মানুষগুলিকে সেবা করতে লাগলো। তিনি যখন তাদিগকে নিয়ে সাগরকূলে বসে আল্লাহ্র øেহের কথা বর্ণনা করতেন–যখন তিনি বলতেন, মানুষের জন্য এক অফুরন্ত আনন্দের রাজ্য আছে, আমরা সেই দিকে যাচ্ছি–ব্যাধিপীড়া দিয়ে খোদা আমাদেরকে তাঁর অসীম øেহের পরিচয় দিচ্ছেন, তখন সবাই কাঁদতো, আকাশ থেকে ফেরেস্তা আশীর্বাদের অশ্রু দিয়ে তাদের সংবর্ধনা করতো, স্তব্ধ সমুদ্রের বুকের উপর দিয়ে বাতাস তাদের শোক-গৌরব গেয়ে ফিরতো।
মোহাম্মদ লুৎফর রহমান তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত যশোর জেলার মাগুরা মহাকুমার (বর্তমান মাগুরা জেলা) পরনান্দুয়ালী গ্রামে ১৮৮৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার মাতা শামসুন নাহার এবং পিতা সরদার মইনউদ্দিন আহমদ, যিনি একজন স্টেশন মাস্টার ছিলেন। এই দম্পতীর চার পুত্র ও এক কন্যার মধ্যে মোহাম্মদ লুৎফর রহমান একজন। তার পৈত্রিক নিবাস ছিল তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহাকুমার হাজীপুর গ্রামে। লুত্ফর রহমানের পিতা ছিলেন এফ.এ পাস। ইংরেজি ভাষা ও ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি তার পিতার অনুরাগ ছিল। সম্ভবত একারণেই পিতার অনুরাগ লুৎফর রহমানের মাঝে প্রতিভাস হয়েছিল। নারী সমাজের উন্নতির জন্য নারীতীর্থ নামে একটি সেবা প্রতিষ্ঠান গঠন এবং নারীশক্তি নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন তিনি এবং একজন চিন্তাশীল ও যুক্তিবাদী প্রাবন্ধিক হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। তার প্রবন্ধ সহজবোধ্য এবং ভাবগম্ভীর। মহান জীবনের লক্ষ্য সাহিত্যের মাধ্যমে মহান চিন্তাচেতনার প্রতি আকৃষ্ট হতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনি। গভীর জীবনবোধ, মানবিক মূল্যবোধ, উচ্চ জীবন, সত্য জীবন, মানব জীবন, সূহ্ম বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি তার রচনার প্রসাদগুণ। প্রবন্ধ ছাড়াও তিনি কবিতা, উপন্যাস ও শিশুতোষ সাহিত্য রচনা করেছেন। এফ.এ অধ্যয়নকালীন সময়ে লুৎফর রহমান তার নিজ গ্রাম হাজীপুরের 'আয়েশা খাতুন' নামে এক মহিলা সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আয়শা খাতুনের পিতা মোহাম্মদ বদরউদ্দীন এ সময়ে মুন্সীগঞ্জ রেলওয়ের বুকিং ক্লার্ক ছিলেন। লুৎফর রহমানের সাহিত্য সাধনা শুরু হয়েছিল মূলত কবিতা রচনার মাধ্যমে। ১৯১৫ সালে চল্লিশটি কবিতা নিয়ে তার প্রথম এবং একমাত্র কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ প্রকাশিত হয়। পরে তিনি বিভিন্ন প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটগল্প, কথিকা, শিশুতোষ সাহিত্য ইত্যাদি রচনা করেছেন। তার কিছু অনুবাদ কর্মও পাওয়া যায়। চরম দারিদ্রের মুখোমুখি যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে মানবতাবাদী সাহিত্যিক ডাক্তার লুৎফর রহমান ১৯৩৬ সালের ৩১ মার্চ ৪৭ বৎসর বয়সে বিনা চিকিৎসায় নিজ গ্রাম মাগুরার হাজিপুর গ্রামে মৃত্যুবরন করেন