""পথের পাঁচালী" বিভূতিভূষণের প্রথম উপন্যাস (১৯২৯) প্রকাশিত হতো না, যদি বন্ধু নীরোদ সি চৌধুরী আর সজনীকান্ত দাস মহাশয়রা এগিয়ে না আসতেন।আর পথের পাঁচালী না প্রকাশিত হলে আমরা পেতাম না বিভূতিভূষণ এবং সত্যজিত রায়কে। সে গল্প একটু বলি। বিভূতিভূষণ তখন ভাগলপুরে খেলাত ঘোষ এস্টেটের অধীনে ম্যানেজারের দায়িত্ব নিয়ে এস্টেটের কাজকর্ম দেখাশোনা করতে গেছেন।বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান একাকী। সন্ধ্যেবেলায় খাটিয়া বসে শোনেন দূর থেকে ভেসে আসা জন্তু জানোয়ারের ডাক। কখনও জ্যোৎস্নার আলোয় দেখেন হরিন, নীলগাই এর দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে দিন এগিয়ে চলে। এভাবেই একদিন আঁকা শুরু হ'ল "পথের পাঁচালী "- র কাহিনি। তখন উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের "বিচিত্রা" পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে তখন রবীন্দ্রনাথ লিখছেন। উপেন্দ্রনাথের পথের পাঁচালী পান্ডুলিপি পড়ে ভাল লাগল। বিচিত্রা পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে বের হতে লাগল দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সংখ্যা থেকে।পাঠকমহলে দারুণ আলোড়ন পড়ে গেল। কিন্ত এবার তো বই আকারে প্রকাশ করতে হবে? ভাগলপুর থেকে বিভূতিভূষণ কোলকাতায় প্রকাশকের দরজায় দরজায় ঘুরলেন। কিন্ত কেউ ছাপতে রাজি হলেন না। কোন কোন প্রকাশক বললেন, ধূর মশাই! পয়সা খরচ করে আপনার পাঁচালী ছাপতে যাবো কেন? না আছে প্রেম, সেক্স, শুধু গাছপালা, লতাপাতা.. আরে এতো "বটানি" র বই। পঞ্চাশ টাকা দিচ্ছি রেখে যান, ভেবে দেখবো।বিভূতিভূষণ হতাশ হয়ে ভাগলপুর চলে গেলেন পান্ডুলিপি নিয়ে।আশা ছেড়ে দিলেন বই প্রকাশের।বন্ধু নীরোদ সি চৌধুরী একদিন কি মনে করে বিভূতিভূষণের কাছ থেকে পান্ডুলিপি নিয়ে এলেন। শনিবারের চিঠি পত্রিকার সভায় বললেন, আমাদের কিছু একটা করতে হবে। এ বই আমাদের প্রকাশ করতে হবে, আমরা প্রত্যেকে কিছু কিছু টাকা দিয়ে এই বই ছাপবো।সজনীকান্ত বললেন, পান্ডুলিপিটা আমায় দাও। সজনীকান্ত সারা রাত জেগে পড়লেন সেই পান্ডুলিপি। ভোর চারটেয় পড়া শেষ হলো। ঐ সকালেই ঠিক করলেন নিজে একটা প্রকাশনী সংস্থা খুলে এ বই ছাপবেন। সজনীকান্ত তাঁর ভাবী পুত্রের নামে সকালবেলায় একটি প্রকাশনী খুললেন। নাম দিলেন " রঞ্জন "প্রকাশনী। টাকা দিলেন সাহিত্যিক গোপাল হালদারের বাবা। একবার ভাবুন বন্ধুরা, কিসব ঘটনা ঘটে চলেছে নিমেষের মধ্যে, যা অকল্পনীয়! মহালয়ার দিন প্রকাশিত হলো" পথের পাঁচালী"(১৯২৯)। বাংলা সাহিত্যে নতুন তারার আবির্ভাব হলো।বাকিটা ইতিহাস।এরপর এই পথ বেয়ে এলেন "পথের পাঁচালী " চলচ্চিত্রের রূপকার সত্যজিত রায়।পথের পাঁচালীর জন্ম না হলে, না পেতাম বিভূতিভূষণ না পেতাম সত্যজিত রায়কে।।বাঙালি অনেক গালাগাল দিয়েছে নীরোদ সি চৌধুরী আর সজনীকান্ত দাসকে। আজকের দিনে আসুন তাঁদের একটু ধন্যবাদ দিই।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।