ভূমিকা নিজের কবিতা নিজে বাছাই করার মস্ত ঝুঁকি তার উপর নিজের সমগ্র কবিতা থেকে কেবল শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোকে খুঁটে নেওয়া, সে তো আরো দুরূহ দায়। এ যেন কোনো জননীর কাছে জিজ্ঞাসার মতো, আপনার সন্তানদের মধ্যে কে বেশি প্রিয়? যে ছেলেটি কানা কিংবা খোঁড়া, তার সম্পর্কে মায়ের মমতা নাকি গভীর। কবিদের ক্ষেত্রেও এটা কম সত্যি নয়। হয়তো বক্তব্যে অগভীর কিন্তু ছন্দের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, এমন একটা কবিতা সম্পর্কে একজন কবি স্বভাবতই হবেন মমতাময়। এবং নির্বাচনের সময় সেটিকে বর্জন করতে গিয়ে শুধু যে হাতই কাঁপবে তা নয়, মনের ভিতরেও কাঁপুনি তুলবে কিছু একটা। অথবা এমন হতে পারে, দুর্বল একটা কবিতার একটি কি দুটি পংক্তির মধ্যে জড়িয়ে আছে প্রবল আলোড়নময় কোনো ব্যক্তিগত স্মৃতির তীব্র তাপ। সেই পংক্তি ক’টি চোখের সামনে এলেই দমকা হাওয়ার মতো মনের ভিতরে ঢুকে পড়ে হারানো এক জলজ্বলে অতীত। শ্রেষ্ঠত্বের সারিতে তাকে বসানো যাবে না জেনেও কবির মমতাচ্ছন্ন আঙুল বারে বারেই উল্টে দেখতে চাইবে সে কবিতাকে। এই ভাবেই নিজের কবিতা নিজে নির্বাচন একজন কবির ক্ষেত্রে বিপদসঙ্কুল এবং বিঘœময়। এই বইয়ের প্রকাশক চেয়েছিলেন অন্য কোনো কবিকে দিয়ে নির্বাচনটা করিয়ে নিতে। সে প্রস্তাবে হ্যাঁ বলতে পারিনি যে-সব কারণে, তার মধ্যে প্রথমটা হলো কালক্ষয়। শেষ পর্যন্ত, নিজেকেই নিজের কঠোর সমালোচক সাজিয়ে এবং মমতার মাত্রা কিঞ্চিৎ কমিয়ে এবং নির্দয়তার দাপট কিছুটা বাড়িয়ে, বসে গেলাম বিচারকের আসনে। অবশ্য এই কাজে পরোক্ষাভাবে সাহায্য পেয়েছি কয়েকজন পাঠকের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে। আমার কবিতার কোনো কোনো অনুরাগী পাঠক শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলন প্রকাশিত হতে চলেছে জানতে পেরে, চিঠিতে দীর্ঘ তালিকা তৈরি করে পাঠিয়েছেন তাঁদের পছন্দ অনুযায়ী। পরিশেষে অনুরোধ জানিয়েছেন, এগুলো যেন অবশ্য অন্তর্ভুক্ত হয় সংকলনে। সব চেয়ে দীর্ঘ তালিকা পেয়েছি একজন কবির কাছ থেকে। সুব্রত রুদ্র। তাঁর আন্তরিকতা এবং পরিশ্রমী আবেগে আমি আপ্লুত। কিন্তু তাঁদের সব অনুরোধকে যে সম্মানিত করতে পেরেছি, তা-ও না। তাঁদের কোনো কোনো প্রিয় কবিতা হয়তো নানা কারণে এখন আর আমাকে নাড়া দেয় না। ভালোবাসাবাসির সম্পর্ক ভেঙে গেলে যেমন খুঁত বের করি কোনো কোনো গুণসম্পন্না সুন্দরীরও, অথবা কানের সামনে অন্য কেউ তার প্রশংসা করলে ভুরু কোঁচকাই, কোনো কবিতার সঙ্গেও এক সময় সম্পর্কটা হয়ে যায় সেই রকমই। প্রথম কবিতার বই বেরিয়েছিল ১৯৫১-য়। মূলত নিজেই প্রকাশক। কাকার ছাপাখানায় বিনে পয়সায় ছাপা। বাংলা কবিতায় তখন অগ্নিযুগ। দ্বিতীয় কবিতার বই একুশ-বাইশ বছর পরে। তার মানে এই নয় যে এই ক’বছর কবিতা লিখিনি! ৫১ থেকে আরো প্রায় ছ’সাত বছর যা লিখেছি তার অধিকাংশই আমার রাজনৈতিক জীবনযাপনের ফসল। পরিচয়, নতুন সাহিত্যে ইত্যাদির পত্রিকায় অজস্র ছড়ানো। এখন গ্রথিত হয়নি কোনো বইয়ে। তারপর দীর্ঘ দিন কবিতা লেখা সত্যিই বন্ধ। প্রধান কারণ সম্ভবত রাজনৈতিক হতাশা। ‘কৃত্তিবাস’কে কেন্দ্র করে সুনীল শক্তি শঙ্খ ঘোষ প্রমুখদের প্রবল উত্থানের দিনে ছিলাম তুলিতে সক্রিয়, কলমে পঙ্গু। আবার একেবারে পঙ্গু বলাটাও মিথ্যে। তখন গদ্যে যতটা আগ্রহী, গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধে যতটা মনোযোগী, কবিতার প্রতি প্রায় ততটাই নিস্পৃহ! আসলে কবিতা ছিল; কিন্তু তার স্রোত চাপা পড়ে গিয়েছিল পুরু বালুচরে। অনেক খোঁড়াখুঁড়ি করলে আঁজলা কয়েক হয়তো বা পাওয়া যেত। এইভাবে ৭৪ পর্যন্ত। তারপর আবার কীভাবে কবিতার জগতে ফিরে আসা এবং অনর্গল জলস্রোতের জোয়ার ফিরে পাওয়া, সে অন্য প্রসঙ্গ। এ পর্যন্ত কবিতার বই বেরিয়েছে দশখানা। এই সংকলনে গত দু’বছর আগে প্রকাশিত বই থেকে কোনো রচনা সংগৃহীত হয়নি। প্রথম সাতটি বই থেকে বাছাই-করা এই কবিতা সংকলন, যার ভালো এবং মন্দের দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে আমারই, পাঠকদের সামান্য তৃপ্তি দিলেই কৃতার্থ। পূর্ণেন্দু পত্রী
জন্ম ফেব্রুয়ারি ২, ১৯৩১ - মার্চ ১৯, ১৯৯৭পূর্ণেন্দু পত্রী নামে সর্বাধিক পরিচিত; ছদ্মনাম সমুদ্রগুপ্ত) একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, সাহিত্য গবেষক, কলকাতা গবেষক, চিত্র-পরিচালক ও প্রচ্ছদশিল্পী। পূর্ণেন্দু পত্রীর জন্ম বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার নাকোলে। পিতা পুলিনবিহারী পত্রী, মা নির্মলা দেবী। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর পারিবারিক কলহের কারণে পৈত্রিক ভিটে ছেড়ে চলে আসেন কলকাতায়। ১৯৪৯ সালে ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে ভর্তি হন বাণিজ্যিক শিল্পকলা বা কমর্শিয়াল আর্টের ছাত্র হিসেবে। যদিও নানা কারণে এই পাঠক্রম শেষ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। ছেলেবেলায় বাগনানের বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা অমল গাঙ্গুলির সংস্পর্শে এসে কমিউনিস্ট পার্টির নানান সাংস্কৃতিক কাজকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। কলকাতায় অভিভাবক কাকা নিকুঞ্জবিহারী পত্রীর চলচ্চিত্র পত্রিকা 'চিত্রিতা' ও সাহিত্যপত্র দীপালি-তে তাঁর আঁকা ও লেখার সূচনা হয়। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য হয়ে পড়লে রাজনীতি ও সাহিত্যচর্চা উভয়েই একসঙ্গে চালাতে থাকেন। মৃত্যুর পূর্বে ১৯৯৬ সালে তার প্রথম খণ্ড বঙ্কিম যুগ প্রকাশিত হয়। শিশুসাহিত্যেও তিনি ছিলেন এক জনপ্রিয় লেখক। ছোটোদের জন্য লিখেছেন আলটুং ফালটুং, ম্যাকের বাবা খ্যাঁক, ইল্লীবিল্লী, দুষ্টুর রামায়ণ, জুনিয়র ব্যোমকেশ, জাম্বো দি জিনিয়াস, প্রভৃতি হাসির বই। আমার ছেলেবেলা নামে তাঁর একটি স্মৃতিকথাও রয়েছে। সামগ্রিক সাহিত্যকর্মের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে বিদ্যাসাগর পুরস্কারে ভূষিত করেন। ১৯৬৫ সালে প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প অবলম্বনে তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র স্বপ্ন নিয়ে মুক্তি পায়। এর পর রবীন্দ্রনাথের কাহিনি অবলম্বনে স্ত্রীর পত্র ও মালঞ্চ সহ পাঁচটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন তিনি। এছাড়াও নির্মাণ করেন সাতটি তথ্যচিত্র। স্ত্রীর পত্র চলচ্চিত্রটির জন্য তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চিত্রনির্মাতা ও শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৭৪ সালে সমরেশ বসুর কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত তাঁর ছেঁড়া তমসুক চলচ্চিত্রটিও একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছিল।