পলায়ন রোজই পুকুরের ধার দিয়া একটা আভরণহীনা যুবতী মেয়েকে যাইতে দেখিয়া হোসেন একদিন তার মাকে জিজ্ঞাসা করিল–মা, কে এই মেয়েটি? মা বলিলেন–ওকে চেন না বাবা? ও যে নিয়ামতের মেয়ে। ওর স্বামী ওকে তালাক দিয়েছে। বালিকার নিঃসহায় অবস্থার কথা শুনিয়া হোসেন একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। কেন এমন সুন্দরী মেয়েটিকে তাহার হতভাগা স্বামী ফেলিয়া দিয়াছে? এত সুষমার অনাদর করিয়া লক্ষ্মীছাড়া লোকটি হয়তো কোনো নূতন বালিকার সন্ধানে ছুটিয়াছে–নারী তো সব জায়গায়ই এক, কেবল কল্পনাতে আমরা দুই করিয়া লই। হোসেনের মা তখন ভিন্ন প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিয়াছিলেন। শেষ বেলার কিরণ-রেখাগুলি সোনালি গৌরবে গাছগুলিকে রাঙাইয়া দিয়াছিল। বাগানের পার্শ্ব দিয়া গ্রামের ছোট রাস্তাটি গিয়াছে। একখানি লোহার বেঞ্চে বসিয়া হোসেন ভাবিতেছিল সেই মেয়েটির কালো চোখ আর তার সুন্দর ম্লান মুখখানির ছবি। কল্পনায় সে দেখিল, মেয়েটি কাতর চোখে তাহার দিকে তাকাইয়া আছে। তার মৌন আঁখি দুটির ভিতর হইতে একটা কাতর নিবেদন বাহির হইতেছে–ওগো যুবক, আমার নিঃসহায় জীবনের অবলম্বন তুমি, আমার বালিকা প্রাণের সকল সুরভি তোমার পূজায় ব্যয় হইয়া গিয়োছে। তখন সন্ধ্যার ম্লান আঁধার গ্রামখানিকে ঘিরিয়া আসিতেছিল। ময়লা কাপড়পরা একটা প্রৌঢ়া এই সময় হোসেনের সম্মুখ দিয়া যাইতেছিল। হোসেন কোমলকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল–আবির মা কোথায় যাচ্ছ? আবির মা সরস নম্র কণ্ঠে কহিল–ও পাড়ায় ধান ভানতে গিয়েছিলাম, এই ফিরছি। হোসেন–তোমার মেয়ে কোথায়? প্রৌঢ়া–কে, আবির কথা বলছ? গরিবের মেয়ের কথা কেন জিজ্ঞাসা করছ, গরিবের কথা তো কেউ জিজ্ঞাসা করে না। হোসেন–আবির বয়স বেশি নয়, দেখে-শুনে একটা বিয়ে দিয়ে দাও। আবির মা–বাবা, এ সংসারে ধর্ম আছে কি? কার হাতে দেব? দু'দিন পরেই তালাক দেবে। আমাদের ছোট লোকের মাঝে মেয়ে মানুষের মান নেই। হোসেন–এমন সুন্দরী মেয়েকে কেউ বিয়ে করে না? আ-মা–বিয়ে করে বই কি! দু'দিন পরেই তালাক দিয়ে চুল ধ'রে তাড়িয়ে দেবে। হোসেন একটা মর্মান্তিক বেদনা অনুভব করিল। আহা, বিধাতার এত সৌন্দর্যের এত অবমাননা! হোসেন পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল–তোমাদের দু'টি প্রাণীর কী ক'রে চলে? আÑমা–ছাই চলে বাবা! এক বেলা ক'রে খাই। হোসেন–মেয়েও তো কাজ করতে পারে? আÑমা–সেয়ানা মেয়ে কোথায় বের হবে? কাপড়খানি ছিঁড়ে কুটি কুটি হ'য়েছে। খোদা কি আছেন? থাকলে রমণী-জীবনে এত দুঃখ কেন? হোসেন পকেট হইতে দুইটি টাকা বাহির করিয়া আবির মায়ের হাতে দিয়া কহিল–তোমার মেয়ের কাপড় কিনে দিও। আবির মা বয়সে মুরুব্বী হইলেও ছেলের বয়সী হোসেনের পা ছুঁইয়া কৃতজ্ঞতা জানাইতে যাইতেছিল। হোসেন বাধা দিয়া কহিল–সে কি, তুমি যে বয়সে আমার অনেক বড়। একটু পরে কহিল–কাল হ'তে আবিকে আমাদের বাড়ি থেকে খাওয়ায়ে নিয়ে যেও। প্রায় দুই মাস হইল আবি হোসেনদের বাড়িতে থাকিয়া কাজ করে। হোসেনকে দেখিলে আবি এতটুকু হইয়া যায়, কিন্তু পালায় না, নত হইয়া কাজ করে। সে যখন ঘর্মাক্ত ললাটে অতীব সংকোচে গরম দুধের পেয়ালাটি লইয়া হোসেনের হাতের কাছে আনিয়া খাড়া হয় তখন তার ওষ্ঠে হাসি ভাসে না, একটা সৌম্য শান্ত করুণায় তাহার মুখখানি জ্বলজ্বল করিতে থাকে। হোসেন অন্যমনস্ক হইয়া একবার হয়তো সে-মুখের দিকে তাকায়, সহসা বালিকার প্রতি তাহার একটা বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা জাগিয়া ওঠে। হোসেনের চাচাতো বোন হাফেজা নামাজ ও কোরান শরীফ পড়ে। কিন্তু তাহার কর্কশ কথা ও রূঢ় ব্যবহার পাড়াপ্রতিবেশীর মাঝে তাহাকে নিতান্তই বিশ্রী করিয়া তুলিয়াছিল। আবি নামাজ না পড়িলেও তাহার শান্ত চোখ দুটি, তাহার সরল নম্র ব্যবহার তাহাকে সুন্দর ও শ্রীময়ী করিয়াছিল। আবি নামাজ পড়িতে জানিলে তাহার মূল্য হাফেজার অপেক্ষা অনেক বেশি হইত। সেদিন হোসেনের মা ভাইয়ের বাড়ি বেড়াইতে গিয়াছিলেন। বাড়িখানি প্রায় নির্জন হইয়া পড়িয়াছিল। যখন সন্ধ্যার ছায়ায় ধরাখানি মৌন হইয়া একটা অজানা অতীত ব্যথার আবৃত্তি করিতেছিল, তখন আবি ঘরের মধ্যে আসিয়া মেজেখানি পরিষ্কার করিতেছিল। মেজে ঝাড়িয়া যখন সে বাহির হইয়া যাইতেছিল তখন হোসেন সহসা তাহার কালো চুড়িপরা হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে লইয়া নিতান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে বলিয়া উঠিল–আবি তোর কেমন লাগে?–জীবনে তোর সুখ আছে? আবির কি যে কহিবে, কিছুই ঠিক করিতে পারিল না–নির্বাক হইয়া শান্ত স্থিরচোখে মেজের কোণার দিকে চাহিয়া রহিল। হোসেন আবার কহিল–আবি, তোকে আমি–, তুই তাতে রাজি আছিস? এবার আবি হোসেনের মুখের দিকে চাহিল! এমন করিয়া ইহার পূর্বে আর সে কখনও হোসেনের মুখের দিকে তাকায় নাই। মৃদুকণ্ঠে কহিল–লোকে শুনলে কী বলবে? হোসেন–লোকে যাই বলুক, আমি যদি তোকে বিয়ে করি তাতে তোর মত আছে কি? আবি কথা কহিল না। অশ্রুধারা বহিয়া মাটি ভিজাইয়া দিল। মাতার অনুপস্থিতিতেই হোসেন তার পরের দিন গোপনে আবিকে বিবাহ করিল।
মোহাম্মদ লুৎফর রহমান তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত যশোর জেলার মাগুরা মহাকুমার (বর্তমান মাগুরা জেলা) পরনান্দুয়ালী গ্রামে ১৮৮৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার মাতা শামসুন নাহার এবং পিতা সরদার মইনউদ্দিন আহমদ, যিনি একজন স্টেশন মাস্টার ছিলেন। এই দম্পতীর চার পুত্র ও এক কন্যার মধ্যে মোহাম্মদ লুৎফর রহমান একজন। তার পৈত্রিক নিবাস ছিল তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহাকুমার হাজীপুর গ্রামে। লুত্ফর রহমানের পিতা ছিলেন এফ.এ পাস। ইংরেজি ভাষা ও ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি তার পিতার অনুরাগ ছিল। সম্ভবত একারণেই পিতার অনুরাগ লুৎফর রহমানের মাঝে প্রতিভাস হয়েছিল। নারী সমাজের উন্নতির জন্য নারীতীর্থ নামে একটি সেবা প্রতিষ্ঠান গঠন এবং নারীশক্তি নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন তিনি এবং একজন চিন্তাশীল ও যুক্তিবাদী প্রাবন্ধিক হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। তার প্রবন্ধ সহজবোধ্য এবং ভাবগম্ভীর। মহান জীবনের লক্ষ্য সাহিত্যের মাধ্যমে মহান চিন্তাচেতনার প্রতি আকৃষ্ট হতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনি। গভীর জীবনবোধ, মানবিক মূল্যবোধ, উচ্চ জীবন, সত্য জীবন, মানব জীবন, সূহ্ম বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি তার রচনার প্রসাদগুণ। প্রবন্ধ ছাড়াও তিনি কবিতা, উপন্যাস ও শিশুতোষ সাহিত্য রচনা করেছেন। এফ.এ অধ্যয়নকালীন সময়ে লুৎফর রহমান তার নিজ গ্রাম হাজীপুরের 'আয়েশা খাতুন' নামে এক মহিলা সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আয়শা খাতুনের পিতা মোহাম্মদ বদরউদ্দীন এ সময়ে মুন্সীগঞ্জ রেলওয়ের বুকিং ক্লার্ক ছিলেন। লুৎফর রহমানের সাহিত্য সাধনা শুরু হয়েছিল মূলত কবিতা রচনার মাধ্যমে। ১৯১৫ সালে চল্লিশটি কবিতা নিয়ে তার প্রথম এবং একমাত্র কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ প্রকাশিত হয়। পরে তিনি বিভিন্ন প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটগল্প, কথিকা, শিশুতোষ সাহিত্য ইত্যাদি রচনা করেছেন। তার কিছু অনুবাদ কর্মও পাওয়া যায়। চরম দারিদ্রের মুখোমুখি যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে মানবতাবাদী সাহিত্যিক ডাক্তার লুৎফর রহমান ১৯৩৬ সালের ৩১ মার্চ ৪৭ বৎসর বয়সে বিনা চিকিৎসায় নিজ গ্রাম মাগুরার হাজিপুর গ্রামে মৃত্যুবরন করেন