সন্ধ্যা উত্তীর্ণপ্রায়, বন্দনা আসিয়া দ্বিজদাসের ঘরের সম্মুখে দাঁড়াইয়া ডাকিল, একবার আসতে পারি দ্বিজবাবু? ভিতর হইতে সাড়া আসিল, পার। একবার নয়, শত সহস্র অসংখ্য বার পার। বন্দনা দরজার পাল্লা-দুটা শেষপ্রান্ত পর্যন্ত ঠেলিয়া দিয়া প্রবেশ করিল এবং ঘরের সবকয়টা আলো জ্বালিয়া দিয়া খোলা দরজার সম্মুখে একটা চৌকি টানিয়া লইয়া উপবেশন করিল। দ্বিজদাস হাতের বইটা একপাশে উপুড় করিয়া রাখিয়া বিছানায় উঠিয়া বসিয়া বলিল, কি হুকুম? কি পড়ছিলেন? ভূতের গল্প। অতিথি বড়, না, ভূতের গল্প বড়? ভূতের গল্প বড়। বন্দনা বিরক্ত হইয়া বলিল, সকল সময়েই তামাশা ভাল নয়। আমরা যে আপনার বাড়িতে অতিথি এ জ্ঞান আপনার আছে? দ্বিজদাস কহিল, তোমরা যে দাদার বাড়িতে অতিথি এ জ্ঞান আমার পূর্ণমাত্রায় আছে। এবং বাড়িওলা আদেশ দিয়ে গেছেন তোমাদের যত্নের যেন কোন ত্রুটি না হয়। ত্রুটি নিশ্চয় হত না, কিন্তু এই ভূতের গল্পটায় আত্মবিস্মৃত হয়ে কর্তব্যে কিঞ্চিৎ শৈথিল্য ঘটেছে। অতএব অতিথির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। সমস্ত দিনটা আমার কত কষ্টে কেটেছে জানেন? নিশ্চয় জানি। নিশ্চয় জানেন, অথচ, প্রতিকারের কি কোন উপায় করেছেন? দ্বিজদাস কহিল, না করার প্রথম কারণ পূর্বেই নিবেদন করেছি। দ্বিতীয় কারণ, এ প্রতিকার আমার সাধ্যাতীত। কেন? সে আমার বলা উচিত নয়। বন্দনা জিজ্ঞাসা করিল, মা এবং মেজদি এমন হঠাৎ বাড়ি চলে গেলেন কেন? মেজদি গেলেন প্রবলপরাক্রান্ত শাশুড়ীর হুকুম বলে। নইলে তিনি নির্দোষ। কিন্তু মা গেলেন কেন? মা-ই জানেন। আপনি জানেন না? দ্বিজদাস কহিল, একেবারেই জানিনে বললে, মিথ্যা বলা হবে। কারণ, বৌদি কিঞ্চিৎ অনুমান করেছেন এবং আমি তার যৎসামান্য একটু অংশ লাভ করেচি। বন্দনা বলিল, সেই যৎসামান্য অংশটুকুই আমাকে আপনার বলতে হবে। দ্বিজদাস এক মুহূর্ত মৌন থাকিয়া কহিল, তবেই বিপদে ফেললে বন্দনা। এ কথা কি তোমার না শুনলেই চলে না? না, সে হবে না, আপনাকে বলতেই হবে। না-ই বা শুনলে? বন্দনা বলিল, দেখুন দ্বিজবাবু, আমাদের শর্ত হয়েছিল, এ বাড়িতে আপনার সমস্ত কথা আমি শুনব এবং আপনিও আমার সমস্ত কথা শুনবেন। আপনি জানেন আপনার একটি আদেশও আমি লঙ্ঘন করিনি। বলিতে গিয়া তাহার চোখে জল আসিতেছিল, আর একদিকে চাহিয়া তাহা কোনমতে সামলাইয়া লইল। দ্বিজদাস ব্যথিত হইয়া বলিল, নিতান্ত অর্থহীন ব্যাপার তাই বলার আমার ইচ্ছে ছিল না। মা তোমার পরেই রাগ করে চলে গেছেন বটে, কিন্তু তোমার কিছুমাত্র অপরাধ নেই। সমস্ত দোষ মার নিজের। বৌদিদিরও কিঞ্চিৎ আছে, কারণ প্রত্যক্ষে না হলেও পরোক্ষে চক্রান্তে যোগ দিয়েছিলেন বলেই আমার সন্দেহ। কিন্তু সবচেয়ে নিরপরাধ বেচারা দ্বিজদাস নিজে। বন্দনা অধীর হইয়া উঠিল, —বলুন না শিগগির চক্রান্তটা কিসের? দ্বিজদাস বলিল, চক্রান্ত শব্দটা বোধ হয় সঙ্গত নয়। কিন্তু মা করেছিলেন মনে মনে স্বর্ণলঙ্কা-ভাগ। কিন্তু হিসেবের ভুলে ভাগ্যে পড়ল যখন শূন্য তখন সমস্ত সংসারের উপর গেলেন চটে। চটাও ঠিক নয়, অনেকটা আশাভঙ্গের ক্ষুব্ধ অভিমান। বন্দনা নীরবে চাহিয়া রহিল, দ্বিজদাস বলিতে লাগিল, জানো নিশ্চয়ই যে একদিন তোমার প্রতি ছিল তাঁর যত বড় বিতৃষ্ণা আর একদিন জন্মালো তাঁর তেমনি গভীর স্নেহ। রূপে, গুণে, বিদ্যায়, বুদ্ধিতে, কাজকর্মে, দয়া-মায়ায় একা বৌদি ছাড়া মার কাছে কেউ তোমার আর জোড়া রইলো না। তোমাকে ম্লেচ্ছ বলে সাধ্য কার? তখনি মা কোমর বেঁধে প্রমাণ করতে বসতেন এতবড় নিষ্ঠাবতী ব্রাহ্মণ-তনয়া সমস্ত ভারতবর্ষ হাতড়ালে খুঁজে মিলবে না। এই বলিয়া দ্বিজদাস নিজের রসিকতার আনন্দে অট্টহাস্য করিয়া উঠিল। এ হাসি বন্দনার অত্যন্ত খারাপ লাগিলেও সে নিজেও হাসিয়া ফেলিল। দ্বিজদাস বলিল, হাসচ কি বন্দনা, আসলে সেই ত হয়েছে সকলের বিপদ। বন্দনা কহিল, এতে বিপদ হবে কিসের জন্যে?
বাঙালির জীবনের আনন্দ-বেদনাকে সাবলীল স্বচ্ছন্দ ভাষায় যে কথাশিল্পী পরম সহানুভূতি ভরে তুলে ধরেছেন বাংলা সাহিত্যে, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৭৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, হুগলি জেলার ছোট্ট গ্রাম দেবানন্দপুরে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শরৎচন্দ্র। দারিদ্র্যের কারণে তাঁর শৈশবকাল বলতে গেলে মাতুলালয় ভাগলপুরেই কেটেছে। দারিদ্র্যের কারণে ফি দিতে না পেরে বেশ কয়েকবার স্কুল বদলিও করতে হয়েছিলো ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত ও মেধাবী শরৎচন্দ্রের। এন্ট্রান্স পাস করে কলেজে ভর্তি হলেও এফএ পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না পেরে পরীক্ষায় বসতে পারেননি। দারিদ্র্য যখন শিক্ষাজীবনে অব্যহতি টানলো, তারপরই শুরু হলো আপাত সাধারণ এই মানুষটির বর্ণাঢ্য কর্ম ও সাহিত্যজীবন। এ সময় প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টের বাড়িতে আয়োজিত সাহিত্যসভায় লেখালেখির অনুপ্রেরণা ফিরে পেলেন যেন আবার। যার ফলশ্রুতিতে বাংলা সাহিত্য পেয়েছিলো বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা’র মতো কালোত্তীর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর উপন্যাস সমগ্র। কাছাকাছি সময়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অনুপমার প্রেম, আলো ও ছায়া, হরিচরণ, বোঝা ইত্যাদি রচিত হয়। বনেলী রাজ স্টেটে সেটলমেন্ট অফিসারের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন এসময়। কিন্তু তারপরই বাবার উপর অভিমান করে সন্ন্যাসদলে যোগ দিয়ে গান ও নাটকে অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন। কখনও কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদক, আবার বার্মা রেলওয়ের হিসাব দপ্তরের কেরানি হিসেবেও কাজ করেন শরৎচন্দ্র। রাজনীতিতেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ১৯২১ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে, এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে। এর মাঝে নিরন্তর চলেছে নিজস্ব জীবনবোধ ও অভিজ্ঞতা উৎসারিত সাহিত্যচর্চা। সমষ্টি আকারে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গল্প সমগ্র বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য, শ্রীকান্ত-৪ খন্ড, কাশীনাথ, ছেলেবেলার গল্প ইত্যাদি সময় নিয়ে প্রকাশিত হলেও পেয়েছিলো দারুণ পাঠকপ্রিয়তা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমূহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এবং বিশ্বব্যাপী পাঠকের কাছে হয়েছে সমাদৃত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমগ্র দেবদাস, শ্রীকান্ত, রামের সুমতি, দেনা-পাওনা, বিরাজবৌ ইত্যাদি থেকে বাংলাসহ ভারতীয় নানা ভাষায় নির্মিত হয়েছে অসাধারণ সফল সব চিত্রনাট্য ও চলচ্চিত্র। সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য এই খ্যাতিমান বাংলা সাহিত্যিক কুন্তলীন পুরস্কার, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি লাভ করেন। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।