বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৯৪-১৯৫০) আরেকটি অসাধারণ উপন্যাস ‘ইছামতি’। যশোরের সুন্দরবনের পাশে ইছামতি নদী। উপন্যাসের পটভূমি ইংরেজদের দুঃশাসন, সেই সময়কার গ্রামীণ জীবনের চিত্র, বিভিন্ন প্রথা, কুসংস্কার ইত্যাদি। ইছামতির পাশে পাঁচপোতা গ্রামের মোল্লাহাটে নীলকুঠিতে বাস করে ইংরেজ লাট শিপটন। তার অত্যাচারে এলাকার চাষীরা বিপর্যস্ত। উপন্যাসে তুলে ধরা হয়েছে নীল চাষের ফলে কৃষকদের হাহাকার ও বিদ্রোহ। সেইসঙ্গে ঔপন্যাসিক দেখিয়েছেন দেওয়ান রাজারামের মতো ইংরেজদের পা-চাটা দেশীয় কুকুর, যারা ইংরেজদের হয়ে প্রজাদের নানা উপায়ে নির্যাতন করে। লেখক এখানে ভবানী বাড়ুয্যে নামে একটি অসাধারণ চরিত্র সামনে এনেছেন। ভবানী সহজ-সরল, ধার্মিক ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি। কুলীনদের জাত-পাতের সমস্যার কবলে পড়ে রাজারামের তিন বোন তিলু, বিলু, নিলুকে একসঙ্গে বিয়ে করতে হয় তাকে। সে সময় কুলীনরা শ’খানেক বিয়ে করতে পারতেন, এমনই নিয়ম ছিল। কুলীন না পেলে কুলীন পরিবারের মেয়েদের বিয়েই হতো না। ভবানী ভালবেসেছিলেন তিলুকে, কিন্তু তাতে বঞ্চনাবোধ জন্মায় বাকি দুই বোনের। সেই অপরাধবোধ পীড়া দেয় ভবানীকে। তিলু চরিত্রটা অসাধারণ। মানবদরদী এই নারীকে ভাল লাগবে পাঠকদের। হলা পেকের মতো ডাকাতও তাকে শ্রদ্ধা করে, ভয় পায়। ভবানী অনেক ধার্মিক হলেও চিন্তার জগতে ছিলেন বাকিদের চেয়ে এগিয়ে। তার স্ত্রীদের ঘোমটা ছাড়া চলা, তাদের লেখাপড়া শেখানো, জামাইয়ের সঙ্গে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানো, সাঁতার কাটা- সবই তিনি ঠিক মনে করতেন। গ্রামের যে কটা মেয়ে লোকলজ্জাকে জলাঞ্জলি দিয়ে স্বাধীন জীবনযাপন করতো, তাদের তিনি শ্রদ্ধা করতেন। ভবানী মানুষের মধ্যে ঈশ্বরকে খুঁজে পান, ঈশ্বরকে খুঁজে পান তার শিশু পুত্রের মধ্যে। ভবানী আর তার স্ত্রীদের নানা ঘটনায় মূর্ত হয়ে ওঠে গ্রামের মানুষজন, তাদের জীবন-জীবিকা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না। ভবানীর মতোই আরেকটি সৎ চরিত্র ওই গ্রামের কবিরাজ। উপন্যাসের আরেকটি চরিত্র গয়ামেম, ভাল লাগার মতো একটা চরিত্র। বড়লাটের রক্ষিতা সে, কিন্তু মমতায় ভরা মন তার। বড়লাটের দুর্দিনে পাশে থাকায় বড়লাট তাকে কিছু জমি লিখে দেন, যা শেষ অবধি গয়াকে বাঁচিয়ে রাখে কোনোমতে। গয়ার মা টাকার লোভে মেয়েকে এ পথে ঠেলে দিয়েছিল। পরে গয়াকে এক ঘরে করে সমাজ, যে সমাজ। প্রসন্ন আমীন গয়াকে ভালবাসলেও বড়লাট শিপটন মারা যাবার পরও তাকে নিয়ে ঘর করতে পারেনি এই সমাজের কারণে। শেষ অবধি গয়ার জন্য কষ্ট হয় পাঠকের। যখন অনেক ছিল গয়ার, তখন সমাজের মানুষগুলো তার কাছ থেকে অনেক কিছু নিয়েছে, কিন্তু দিন খারাপ হবার পর সেই মানুষগুলোই গয়াকে একঘরে করে চলে যায়। উপন্যাসে একটা বিষয় লক্ষ্যনীয়। এখানে ইংরেজদের সময়ে যেমন বাংলার গ্রামগুলোর সাধারণ কৃষকদের আর্থিক ও মানসিক অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে, তেমনি তুলে ধরা হয়েছে ইংরেজদের এদেশিয় দোসরদের আর্থিক অবস্থা এবং ইংরেজদের বিদায়ে তাদের হাহাকার। নীলচাষ বন্ধ হবার পর ইংরেজদের জমিদারী চলে যায় এদেশের বেনিয়াদের হাতে। উপন্যাসে নীলকুঠি বেঁচে দেয়া হয় ব্যবসায়ী লালমোহন পালের কাছে। দেশের অর্থনীতিতে এই পরিবর্তন মানুষের ওপর কেমন প্রভাব ফেলেছিল, তার বর্ণনা নেই এখানে। এখানে মূলত তুলে ধরা হয়েছে ইংরেজ উপনিবেশের শেষদিকের সময়টার চিত্র। সব মিলিয়ে উপন্যাসটা খুব ভাল লাগবে পাঠকের।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।