ভূমিকা ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দ, মে মাস। বাংলা ১৩৪১ সন। সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত মাসিক ‘পূর্ব্বাশা’ পত্রিকার জৈষ্ঠ্য সংখ্যায় প্রকাশিত হলো একটি ধারাবাহিক উপন্যাসের প্রথম কিস্তি। নামপদ্মানদীর মাঝি। লিখেছেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮Ñ ৫৬)। একে একে উপন্যাসটির নয় কিস্তি প্রকাশিত হলো পূর্ব্বাশায়। তারপর, ১৯৩৫ সালের জুন মাসে এর প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৯৩৬ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় এটি। মানিক যখন ‘পদ্মানদীর মাঝি’ লিখছিলেন, তখন তিনি বয়সে তরুণ। ছাব্বিশ কী সাতাশ বছর বয়েস। বাংলা ভাষায় পদ্মা নদী ও তাকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকা মানুষদের নিয়ে এটিই প্রথম কোনো পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস। ভারতের বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষা ছাড়াও ইংরেজি, রুশ, হাঙ্গেরিয়ান, চেক, সুইডিশ, নরওয়েজিয়ান ও লিথুয়ানিয়ান ভাষায় এই উপন্যাসের অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে দুবার এই উপন্যাসের চলচ্চিত্ররূপ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের যৌথ প্রযোজনায় গৌতম ঘোষের মতো গুণী পরিচালক এই উপন্যাসের বাংলা চলচ্চিত্র তৈরি করেন, যেটা মুক্তি পায় ১৯৯৩ সালে। মানিক বন্দোপাধ্যায় রচিত এই উপন্যাস নিঃসন্দেহে সর্বাধিক পঠিত ও আলোচিত বাংলা উপন্যাসগুলোর একটি। ক. প্রেক্ষাপট: পদ্মা ১ “বর্ষার মাঝামাঝি। পদ্মায় ইলিশ মাছ ধরার মরসুম চলিয়াছে। দিবারাত্রি কোনো সময়েই মাছ ধরিবার কামাই নাই। সন্ধ্যার সময় জাহাজঘাটে দাঁড়াইলে দেখা যায় নদীর বুকে শতশত আলো জোনাকির মতো ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। জেলে নৌকার আলো ওগুলি। সমস্ত রাত্রি আলোগুলো এমনিভাবে নদীবক্ষের রহস্যময় ম্লান অন্ধকারে দুর্বোধ্য সংকেতের মতো সঞ্চালিত হয়। এক সময় মাঝরাত্রি পার হইয়া যায়। শহরে, গ্রামে, রেলস্টেশনে ও জাহাজঘাটে শান্ত মানুষ চোখ বুজিয়া ঘুমাইয়া পড়ে। শেষরাত্রে ভাঙা-ভাঙা মেঘে ঢাকা আকাশে ক্ষীণ চাঁদটি ওঠে। জেলে নৌকার আলোগুলো তখনো নেভে না। নৌকার খোল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছ। লণ্ঠনের আলোয় মাছের আঁশ চকচক করে, মাছের নিষ্পলক চোখগুলোকে স্বচ্ছ নীলাভ মণির মতো দেখায়।” রাত্রিকালের পদ্মা, নদীর বুকে ভেসে থাকা জেলে নৌকা, ইলিশ আহরণের দৃশ্যপটএই সাবলীল শৈল্পিক বর্ণনায় শুরু হয়েছে উপন্যাস। তারপর, লেখক তাঁর উপন্যাসের জায়গায় জায়গায় টেনেছেন পদ্মার রূপ। এঁকেছেন তাঁর চোখে, তাঁর মানসপটে ভেসে ওঠা পদ্মার ছবি। সমুদ্র- অভিমুখী জলপ্রবাহে পদ্মা সর্বদা মুখরিত। পদ্মা যেন চিরযৌবনা। এই নদী প্রাচীন, গভীর ও প্রশস্ত। এই নদী চিররহস্যময়। আবার, কী পরম মমতায় আগলে রেখেছে তীরের মানুষদের! যাদের অধিকাংশই জীবিকা নির্বাহ করে পদ্মা ও এর আশপাশের খাল থেকে মাঝ ধরে, নৌকা বেয়ে। পদ্মা নদী আবার যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমও। বাণিজ্যের মাধ্যম পদ্মা। চিরায়তকাল থেকে যে সুগভীর জলধারা জড়িয়ে আছে অগণিত মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের সাথে, জীবিকার সাথে। ২. উপন্যাসে এসেছে পদ্মাপাড়ের জেলে জীবনের কথা। মানিক তাঁর লেখনিতে ফুটিয়ে তুলেছেন জেলেদের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্খা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কথা। উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়েই আমরা দেখতে পাই শীতল ও ধনঞ্জয় কর্তৃক কুবেরের শোষিত হওয়ার চিত্র। দরিদ্র কুবের বারবার লাঞ্ছিত হয় তাদের কাছে। বঞ্চিত ও উপেক্ষিত হতে হতে সে চৌর্যবৃত্তির আশ্রয় নেয়। সেইসাথে, নৌকা ও জালের মালিক হওয়ার সুবাদে ধনঞ্জয়ের শোষক চরিত্রটি তীব্রতর হয়ে ওঠে। বিনাশ্রমে সে অর্ধেক মালিকানা ভোগ করে পদ্মা থেকে আহরিত মাছের। হোসেন মিয়া এই উপন্যাসের সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়ে ওঠা শোষক চরিত্র। প্রভাবশালী, ধনবান ও প্রচ- ধূর্ত এই চরিত্র তার বৈধ-অবৈধ ব্যবসা আর কালো টাকার জোরে অকূল সমুদ্রের মাঝে মাথা উঁচিয়ে থাকা এক আস্ত দ্বীপের মালিক বনে যায়। ক্রমেই আমরা বুঝতে পারি, হোসেন মিয়া হয়ে উঠছে আরো সংযমী, কৌশলী এবং একইসাথে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। মানুষের অবাসযোগ্য তার সেই ‘ময়নাদ্বীপ’-এ মানব বসতি স্থাপন ও একইসাথে মাদক চোরাচালানির পথ সুগম করতে হোসেন মিয়া খড়গহস্ত হয়ে ওঠে কেতুপুরের জেলেপল্লির ওপর। তার এই শোষণক্ষেত্র বিস্তৃত হয় চারদিকে। আরো কয়েক গ্রামে, একাধিক জনপদে। ৩. প্রসঙ্গত, আবু হেনা মোস্তফা কামালের উক্তি দিয়ে এই পরিচ্ছেটির শুরু করছি। “এই উপন্যাসের আরেক প্রধান চরিত্র পদ্মা। রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পগুলোতে যেমন নায়ক দু’জনপদ্মা এবং পদ্মা তীরবর্তী মানুষ, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’তেও তাই। ...একটি প্রচ- সত্তার মতো এই উপন্যাসের সমস্ত নরনারীর জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে পদ্মা।” ‘পদ্মানদীর দ্বিতীয় মাঝি’, আবু হেনা মোস্তফা কামাল রচনাবলি প্রথম খ-, আনিসুজ্জামান ও বিশ্বজিৎ ঘোষ সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি, ঢাকা ২০০১। ব্যবসা, জীবন-জীবিকা, শোষণ, ময়নাদ্বীপ প্রর্ভতি বিষয় ছাপিয়েও ফুটে ওঠে পদ্মার আরেক রূপ। আমরা খুঁজে পাই পদ্মাকে, এর তীরবাসী মানুষের একমাত্র অবলম্বন হিসেবে, কখনো সংস্কার-কুসংস্কারের উৎস হিসেবে। পদ্মার এই অবিরাম জল¯্রােত বেয়েই মানুষ এগিয়ে যায়। সেই চিত্র আমরা দেখি, আশ্বিনের ঝড়ে আহত গোপীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে। আমিনবাড়ি সরকারি হাসপাতালে যাওয়ার সময় পদ্মাই হয়ে ওঠে একমাত্র পথদ্রুততম, নির্ভরযোগ্য। বিয়ের পর, এই গোপী পদ্মার জলপথ দিয়েই শশুড়বাড়ির পথে যাত্রা করে। সোনাখালির রথমেলা পদ্মাতীরের মানুষের মনে শিহরন জাগায়। পারস্পরিক সম্প্রীতি মজবুত করতে এই মেলা পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পদ্মানদীর বিশালতা তার বুকে নৌকা বেয়ে চলা মাঝিদের মনকে প্রশস্ত করে, উদারতা আনে আরো। সেই ঔদার্যে এক নৌকার মাঝি যেমন অন্য নৌকায় নিরাপদে রাত্রিযাপন করতে পারে, তেমনি, পদ্মার বুকে বিপদগ্রস্ত নিরুপায় কোনো মানুষকে সাহায্য করা, বিনা লাভে পার করে দেয় এক মুহূর্ত না ভেবেই। মানিক এই আচারকে বিস্তৃত করেছেন খানিকটা এভাবে‘মহত্ত্ব নয়, পরোপকার নয়ইহা রীতি, অপরিহার্য নিয়ম।’ পদ্মার বিশালতা দূর করে দেয় জেলেদের মনের সংকীর্ণতা। তাদের সামনে উন্মুক্ত হয়ে যায় সৌহার্দপূর্ণ আচরণের এক আলোকোজ্জ্বল দুয়ার। অজান্তেই। তাই হয়তো কুবের ভাবে‘মুসলমানের হাতের রান্না খেতে দোষ নেই। মাঝির জীবনে এ জিনিস বড় বেমানান।’ ৪. মানিক তাঁর এই অনবদ্য রচনায় নিয়ে এসেছেন দুটো দুর্যোগের কথাবর্ষার বন্যা এবং আশ্বিনের ঝড়। বর্ষার বন্যায় যেন গ্রামের ঘড়বাড়ি গোরুমানুষ কুটার মতো ভেসে যায়। পদ্মার এই প্রলয়ংকরী রূপ চিরায়ত, খুব চেনা। সেই পদ্মাকে মানুষ মোকাবিলা করে, প্রতিবার। এই দুর্যোগের মাঝেই কুবের খুঁজে পায় কপিলাকে। স্বামী-পরিত্যক্ত তরুণী। মানিক বন্দোপাধ্যায় এক বিপদকালীন সময়ের মাঝেই ফুটিয়ে তোলেন কুবের-কপিলার অবাধ্য প্রেমকে। যে প্রেমানুভূতি হয়ে ওঠে বর্ষাও পদ্মার মতই প্রাণোচ্ছল, প্রলয়ংকরী। বন্যার কারণে কুবেরের গৃহে কপিলা দীর্ঘকাল অবস্থান করে। এই দীর্ঘকালীন অবস্থানই কুবেরের সামনে উন্মুক্ত করে তার নতুন এক রূপ। অন্ধকারে নির্জন পদ্মার পাড় হয়ে ওঠে তাদের লীলাক্ষেত্র। উন্মুক্ত হয় অন্তরঙ্গতার সকল পথ, সকল প্রক্রিয়া। কুবেরের প্রতি কপিলার ছলনাভরা হাসি, মুহুর্মুহু বিদ্রুপ, অবাধ্য ভঙ্গিসেসবের মাঝে কুবের যেন আরো তলিয়ে যায় কপিলার মনগঙ্গার বুকে। আশ্বিনের ঝড়ে বিপর্যস্থ অবস্থায়ও যেন সেই ভীষণ প্রেমের রূপ ধরা পড়ে লেককের কলমে। আমিনবাড়ি যাওয়ার পথে একত্র রাত্রিযাপন দুজনকে নিয়ে আসে আরো কাছাকাছি। গল্পের মাঝে, কখনো লেখক কুবেরের চোখ দিয়ে কপিলাকে দেখিয়েছেন, পদ্মার মতো রহস্যময়ী, কখনো দুই তীর প্লাবিত পদ্মার মতো উচ্ছল। কখনো এই নদী প্রত্যক্ষ করেছে তাদের দুজনের বিরহী রূপ। দেখেছে অনিশ্চয়তা, অপ্রাপ্তি, শঙ্কা। চরডাঙার সেই দোল-উৎসবের আমেজে মজে থাকা কুবের আর কপিলার সেই পুকুরে সন্তরণ দৃশ্যের কথা এখানে না টানলেই নয়। কপিলার কাছে কুবের সেবার নিজেকে সমর্পণ করে। নির্ভেজাল কন্ঠে স্বীকার করে তার মনের কথা। বলে, ‘তর লাইগা দিবারাত্র পরানডা পোড়ায় কপিলা।’ জবাবে কপিলা বলে, ‘গাঙের জলে নাও ভাসাইয়্যা দূর দ্যাশে যাইও মাঝি, ভুইলো আমারে।’ কুবের-কপিলার এই ক্ষুদ্র সংলাপটুকু কি দারুণভাবেই না প্রকাশ করে দুজনের মনের টাল- মাটাল অবস্থাকে। মনের কোণে জমে ওঠা মেঘটুকুকে। ঠিক যেভাবে পদ্মার আকাশে মেঘ জমে। আর বান ডাকে পদ্মার বুকে। বারবার। খ. বাস্তবতাবোধ নদীতীরে গড়ে ওঠা জনপদের বিমূর্ত চিত্র মানিক বন্দোপাধ্যায়ের উপন্যাসপদ্মানদীর মাঝি। এখানে উঠে এসেছে শ্রেনিবৈষম্যের কথা, বঞ্চনা ও শোষণের কথা। এসেছে পরিবার, প্রতিবেশী আর প্রেমের কথা। লেখক এখানে যে বঞ্চনার কথা এনেছেন, সে বঞ্চনা সামজিক, আর্থিক, পারিবারিক এবং ধর্মীয়। যেখানে ফুটে উঠেছে ‘উঁচু’ জাত আর ‘নিচু’ জাতের ফারাক। ‘পূর্বদিকে গ্রামের বাহিরে জেলেপাড়া’এই একটি কথা দিয়ে মানিক স্পষ্ট করে তুলেছেন গ্রামীণসমাজকে। যেখানে উচ্চ বংশীয় মানুষ অচ্ছুত বলে জেলেদের ঠেলে দিয়েছেন গ্রামের একপ্রান্তে। বিস্তীর্ণ পদ্মাতীরে। মনিক তাই লেখেন: ‘গ্রামের ব্রাহ্মণও ব্রহ্মণেতর ভদ্র মানুষগুলো তাহাদের দূরে ঠেলিয়া রাখে।’ সেই জেলেপল্লিতে জেগে থাকে কত কথা, কত কিচ্ছা! থাকে নানান সংস্কার, কুসংস্কার। কত নিয়ম, অনিময়! এখানে যেমন পণের বিনিময়ে বিয়ে হয়, তেমনি বিবাহবহির্ভূত আবেগঘন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে নরনারী। এখানে নতুন শিশুর কান্না কখনো বন্ধ হয় না। কেবল ‘টিকিয়া থাকার নির্মম অনমনীয় প্রয়োজনে নিজেদের মধ্যে রেষারেষি কাড়াকাড়ি করিয়া তাহারা হয়রান হয়।’ তাই হয়তো ‘জন্মের অভ্যর্থনা এখানে গম্ভীর, নিরুৎসব, বিষণœ।’ এখানে অস্তি¡ রক্ষার যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা, যে সংগ্রামতার প্রধানতম কারণ অর্থাভাব। এই অর্থাভাব কিংবা দারিদ্র্যের কারণ বিভিন্ন। বংশ পরম্পরায় জেলেবৃত্তি, ক্ষমতাশালীদের শোষণ, নিরক্ষরতা এবং ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দারিদ্র্যের প্রধানতম কারণ। নৌকা চালনা এবং মৎস্য শিকার জেলেবৃত্তির অবশ্য কর্তব্য। এই কাজ যথেষ্ট পরিশ্রমের। এবং সেইসাথে খুব একটা পরিবর্তনও আনতে পারে না জেলেদের জীবনে। বহুলাংশে প্রাকৃতিক অবস্থা এবং নৌকা এবং জাল মালিকদের ওপর নির্ভরশীল এই পেশা নিরীহ জেলে জীবনে ডেকে আনে দৈন্য। আবার, ‘প্রকৃতির কালবৈশাখী তাহাদের ধ্বংস করিতে চায়, বর্ষার জল ঘরে ঢোকে, শীতের আঘাত হাড়ে গিয়া বাজে কনকন।’ লেখক তাঁর সুনিপুণ লেখনিতে ফুটিয়ে তুলেছেন কেতুপুরের জেলেপল্লির মানুষদের সংগ্রামী জীবনযাপন। যে জীবনে আঘাত হানে কালবৈশাখী, আশ্বিনা। বর্ষার প্লাবন বারবার ভাসিয়ে নিয়ে যায় পল্লির ঘরবাড়ি, গবাদিপশু। কখনো সখনো মানুষকেও। আবার তীব্র শীতে কষ্ট পায় জনপদের অসহায় মানুষ। লেখক উপন্যাসে নিয়ে এসেছেন শোষক, শোষিতের চিরকালীন রূপ। জাল, নৌকার মালিক ধনঞ্জয় থেকে শুরু করে জমিদার কর্মচারী শীতল, এবং হোসেন মিয়া শোষক শ্রেণির প্রকট স্বরূপ। ধনঞ্জয়ের প্রভাব ও শীতলের প্ররোচনা দরিদ্র কুবেরকে আস্কারা দেয় মিথ্যাচারের আশ্রয় নিতে, চৌর্যবৃত্তির পথ অনুসরণ করতে। কারণ সে নিরুপায়। ওদিকে অল্প সময়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া হোসেন মিয়ার কৌশলী শোষণ আমরা প্রত্যক্ষ করি বারবার। তার ময়নাদ্বীপ, তার চোরাকারবারি, মাদক ব্যবসাসবকিছু যেন স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলে এই শঠ চরিত্রকে। যার হাতে শোষিত হয় জেলেপিল্লর সহজ, অশিক্ষিত মানুষগুলো। প্রমত্তা পদ্মা মানুষকে করে তোলে কুসংস্কারাচ্ছন্ন। একারণেই ¯্রােতে ভেসে আসা কাঠের টুকরো কেউ ছুঁতে চায় না। অমঙ্গলের ভয়ে। ঝড় বৃষ্টির মাঝে নদীর জল ফুলেফেঁপে উঠলে নানা রকম মানত করে তীরবাসী। উঠানে পিড়ি পেতে দেয়। দেবতাদের শান্ত করতে চায় বলে। আবার, এই নদী তাদের মনকে করে প্রশস্ত। তাই তো বিপদগ্রস্ত কাউকে বিনা প্রাপ্তিতেই নদী পার করে দেয় মাঝিরা, জেলেরা। এই কাজকে তারা উদারতা মনে করে না। মনে করে, নিছক কর্তব্য। এমন না করলেই বরং পাপ হবে। ঘোরতর অন্যায় হবে। গল্পের মাঝে উঠে আসা বারবারবিভিন্নজনের চুরির ঘটনা সামাজিক নীচতাকে তুলে ধরে। একইসাথে, এই প্রবাহমান জলধারা তীরের মানুষকে বঞ্চিত করে না পৌষ- পার্বণ থেকে। আনন্দ থেকে। জেলেপল্লির মানুষ মহা উৎসবে পূজা করে, আয়োজন করে মেলার। রঙে, আবিরে রাঙিয়ে দেয় পরস্পরকে। তবে, সর্বোপরি এই উপন্যাসে লেখক সমাজের কঠিন বাস্তবতাকে তুলে আনতে চেয়েছেন। বলতে চেয়েছেন পদ্মাপাড়ের মানুষের কথা। তাই তো তিনি লিখেছেন‘ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্রপল্লিতে। এখানে তাঁহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাবে না।’ যে কথা শুধু কেতুপুরের হয়ে থাকেনি। ছড়িয়ে পড়েছে সবদিক। আঁচড় কেটেছে পাঠকের মনে। যে কথা হয়ে গেছে জনতার। অজান্তেই। গ. চরিত্র বিশ্লেষণ কুবের ঔপন্যাসিক কুবের নামের এক সাধারণ জেলেকে বেছে নিয়েছেন তাঁর উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে। এই চরিত্র নির্বাচনেই ফুটে উঠেছে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের চিন্তাধারা, নি¤œ শ্রেণির মানুষের প্রতি জমিয়ে রাখা শ্রদ্ধা এবং গভীর মমত্ববোধ। ঔপন্যািসকের বর্ণনায় কুবেরকে দেখা গিয়েছে সহজ-সরল, শোষিতের রূপে। নিতান্ত দরিদ্র জেলে, গায়ের জোরটুকুই যার একমাত্র সম্পদ। নিরীহ হলেও বুদ্ধিহীন সে নয়। তার মধ্যে ফুটে উঠেছে নেতৃত্বগুণ। তেমনি, চারপাশের শোষকদের প্রতি তার ধারণা স্বচ্ছ। উপন্যাসের প্রথমাংশে তাকে দেখা যায় একজন সন্তুষ্ট স্বামীরূপে, সন্তুষ্ট গৃহস্থরূপে। সে তার স্ত্রী মালার প্রতি দায়িত্বশীল। দাম্পত্যজীবন নিয়ে সে অভিযোগহীন। স্ত্রীর পঙ্গুত্ব নিয়ে তার মাঝে কোনো ক্ষোভ নেই। কোনো হতাশা নেই। এরইমাঝে সে অনুভব করে প্রবল অধিকারবোধ। তাই, জমিদারের সাথে মালাকে জড়িয়ে রটনা সে সহ্য করতে পারে না। হয়ে ওঠে ক্ষুব্ধ, বিচলিত এবং বিষণœ। আবার, অসহায় মালার দিকে আগুনসহ তামাকের কল্কি নিক্ষেপ তার অসহিষ্ণু ও অমার্জিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটায়। আবার, পঙ্গু স্ত্রীর প্রতি সে অভিযোগহীন থাকলেও নিষিদ্ধ প্রেম সে উপেক্ষা করতে পারে না। বিবাহিতা, স্বামী-পরিত্যক্ত কপিলার প্রতি জমে ওঠা আবেগ তারই বহিঃপ্রকাশ। যুবতিটির প্রতি তার তীব্র অনুরাগ প্রকাশ পায় উপন্যাসের সাথে এগোতে এগোতে। কপিলা দৃষ্টিসীমার আড়ালে গেলেই ছটফট করে কুবেরের মনপ্রাণ। কপিলার খোঁজে সে ছুটে যায় দূরের আকুরটাকুর গ্রামে। তবে নিজেকে প্রকাশ করতে সে বারবার সংকুচিত হয়ে যায়। তবে, সেবার পুকুরে সন্তরণশীল অবস্থায় যখন নিজের মনের কথা জানায় কপিলার কাছে, তখন তার কণ্ঠে শব্দচয়নে প্রকাশ পায় গভীর আবেগ। সেইসাথে প্রবল আশঙ্কাহারানোর, সমাজের মানুষের জেনে যাওয়ার। সেইসাথে আমরা বুঝতে পারি তার ভেতরে থাকা স্বপ্নাতুর সত্তাকে। যে নিষিদ্ধ জেনেও কপিলার প্রতি তার ভালোবাসা কোনোক্রমেই উপেক্ষা করে যেতে পারে না। সেইসাথে, মাছ চুরি, কন্যার বিয়ে নিয়ে যৌতুক আদায়ের কৌশল, রেলের কয়লা চুরি, হোসেন মিয়ার টাকা চুরির মতো বর্ণনাগুলো আমাদের সামনে প্রতীয়মান করে কুবেরের নীচতা। সেইসাথে, অসৎ, ধূর্ত, ও কূটবুদ্ধির হোসেন মিয়ার প্রতি তার ভয় প্রকাশ করে ক্ষমতাবানদের প্রতি দরিদ্রের চিরায়ত মানসিকতা। মাদক চোরাচালানির খবর প্রকাশ পেয়ে গেলে যে কর্মফল অবশ্যই ভোগ করতে হবে, তার ব্যাপারে কুবের অজ্ঞাত নয়। তবু সে হোসেন মিয়াকে ছাড়তে পারে না। পারে না হোসেন মিয়ার বলয় ছিন্ন করে নিজেকে মুক্ত করতে। কপিলা এই উপন্যাসে কপিলা একজন প্রাণোচ্ছল, একইসাথে কর্তব্যপরায়ণ যুবতির নাম। যে নিঃসন্তান, স্বামী-পরিত্যক্ত। স্বামীগৃহে তার দম আটকে আসে। স্বামী শ্যামদাশের সাথে তার প্রভু-ভৃত্য সম্পর্ক তাকে আকর্ষণ করে না। নিঃসন্তান কপিলার মাঝে বরং জেগে ওঠে ভীষণরকম শূন্যতা, নিঃসীম মাতৃত্মবোধ। বোন মালার গৃহে কুবেরের সাথে নতুনভাবে চেনা পরিচয় তার নিরানন্দ জীবনের মাঝে বাঁক আনে। হঠাৎ, তাদের মধ্যে তৈরি হওয়া বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, হাসি-তামাশা অপূর্ণ কপিলার জীবনে এক ছটা রঙ এঁকে দেয় যেন। কপিলা টের পায়প্রণয়াকাক্সক্ষা। তবে, প্রাণ-প্রাচুর্যে পূর্ণ কপিলা কখনোই ইন্দ্রীয়তাড়িত বা অশালীন নয়। তবে, করিমগঞ্জ যাওয়ার পথে একত্র রাত্রিযাপনের সময় সচেতন কুবেরের নিষ্ক্রিয়ভাব তাকে ভেতরে ভেতরে অভিমানী করে তোলে। তাই হয়তো, সেখান থেকে ফিরে এসে সে স্বামীগৃহের নিরানন্দ, বর্ণহীন জীবনে প্রবেশ করে, বিনাবাক্যব্যয়ে। তবে, সেখানে কুবেরের আকস্মাৎ আগমনে কপিলা নতুন করে স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখে আলোকোজ্জ্বল নতুন জীবনের। স্বপ্ন দেখে কুবেরের হাত ধরে দূরদেশে পাড়ি জমাবার। কপিলার এই স্বপ্ন পূর্ণতা পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় উপন্যাসের শেষ অংশে। ‘ঘাটের খানিক তফাতে হোসেনের প্রকা- নৌকাটি নোঙর করা ছিল। একজন মাঝি ঘুমাইয়া ছিল নৌকায়। তাকে ডাকিয়া তুলিলে সে নৌকা তীরে ভিড়াইল। কুবের নীরবে নৌকায় উঠিয়া গেল। সঙ্গে গেল কপিলা। ছইয়ের মধ্যে গিয়া সে বসিল। কুবেরকে ডাকিয়া বলিল, ‘আমারে নিবা মাঝি লগে?’ হ, কপিলা চলুক সঙ্গে। একা অতদূরে কুবের পাড়ি দিতে পারব না। ’ হোসেন মিয়া বিশ বছরবয়সে নিজগৃহ পলাতক হোসেন মিয়া ভাগ্যান্বেষণে ঘুরেছে দীর্ঘসময়। বহুকাল নৌযানে কর্মরত থেকে কেতুপুরে আবির্ভূত হওয়া হোসেন ছিল কপর্দকশূন্য। অথচ তার মগজের জোর, অধ্যবসায় এবং নিত্য নতুন কৌশল তাকে করেছে বিত্তবান, প্রভাবশালী। সময়ের সাথে সাথে সে হয়ে উঠেছে গোটা একটা দ্বীপের মালিক। যেখানে সে জনবসতি স্থাপনে বদ্ধপরিকর। কেতুপুরের জেলেপল্লির দরিদ্র, অশিক্ষিত লোকজনকে তাই সে দ্বীপবাসী করতে চায়। একারণে সে মুক্ত করে দেয় তার উদার মনোভাব, লোকের বিপদে-আপদে বাড়িয়ে দেয় সাহায্যের হাত। তবে, তার মাথার ভেতর যে প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো কুটিল চিন্তা ঘোরে, বিনিময়হীন কোনো কাজ যে সে করে না, তার ধারণা স্পষ্ট হয়অশিক্ষিত জেলেদের কাছ থেকে টিপসই নেওয়ার দৃশ্যে। সমুদ্রমাঝে জেগে ওঠা ময়নাদ্বীপে জনবসতি তৈরিতে সে বদ্ধপরিকর। কারণ তবেই সেই বিরান দ্বীপ হয়ে উঠবে তার অবাধ চারণক্ষেত্র, উপনিবেশ। সে তৈরি করতে পারবে মাদক চোরাচালানিসহ অন্যসব অবৈধ ব্যাবসার এক অনন্য পথ। নির্বিঘœ ক্ষেত্র। তারপরও, হোসেনের স্বার্থপর মনোভাবের মাঝেও আমরা দেখতে পাই দ্বীপের এবং জেলেপল্লির সাধারণ মানুষের প্রতি তার মিষ্টভাষী, উদার চারিত্রিক দিক। কর্মহীনের কর্ম জুটিয়ে দেওয়া, সালিশ বিচারে তার ভূমিকা আমরা বেশ প্রত্যক্ষ করি। তবে, শেষ পর্যন্ত কুবেরের চোখে প্রকট হয়ে ওঠে হোসেন মিয়ার নেতিবাচক দিকগুলো। আমরা অনুভব করি, কুবেরের অসহায় সত্তাকে। টের পাই, হোসেন মিয়ার চক্রান্ত, লালসা আর ক্ষমতার প্রচ- দাপট! মালা জেলে কুবেরের পঙ্গু স্ত্রী মালা। ভাগ্যের ফেরে তার এই অসহায় অবস্থা। কিন্তু, এই নিয়ে তার তিলমাত্র সংকোচবোধ নেই, দুঃখ নেই। পঙ্গুত্ব নিয়ে সে যতটা সম্ভব স্বামী ও সন্তান, পরিবারের প্রতি নিজের দায়িত্ব কর্তব্য পালনে সচেষ্ট থাকে। তাই তো, তার ¯েœহের জালে আটকে থাকে সন্তানরা, মুগ্ধ হয় পাড়া-প্রতিবেশী, এমনকি কুবেরও তার দায়-দায়িত্ব উপেক্ষা করতে পারে না। তারপরও, স্বামীর হাতে মারধোর ও লাঞ্চনার শিকার হয় এই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারীবারবার। কুবের-কপিলার প্রণয় টের পেলে কপিলা নিজ অক্ষমতা, পঙ্গুত্ব নিয়ে সচেতন হয়ে ওঠে। চিকিৎসকের দ্বারস্থ হতে চায়, আবার। মানিকের শব্দ বুননে আমরা মালা চরিত্রে খুঁজে পাই অসম্ভব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, দৃঢ়চেতা, কর্তব্যপরায়ণ, মায়াময় একজন পঙ্গু নারীকে। যে একজন অভিমানী কন্যা, একজন সচেতন কিন্তু অসহায় স্ত্রী, একজন মমতাময়ী মা। অন্যান্য চরিত্র কুবের, কপিলা, মালা এবং হোসেন আলির পাশাপাশি ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে মানিক বন্দোপাধ্যায় নিয়ে এসেছেন অনেকগুলো চরিত্র। যারা আমাদের সামনে এসেছে কাহিনির প্রয়োজনে, নিজ নিজ প্রেক্ষাপট নিয়ে। কুবেরের বন্ধু গণেশযে কিনা বোকা, অথচ কুবেরের প্রতি বিশ্বস্ততা এবং বন্ধুত্বের প্রেক্ষিতে সে হয়ে ওঠে নির্ভার। ধনঞ্জয় আবির্ভূত হয়েছে নৌকা ও জালের মালিক রূপে, জমিদারের কর্মচারী শীতলউভয়ই প্রকাশিত হয়েছে শোষক, প্রতারক রূপে। ওদিকে সর্বস্ব হারানো রাসু বিয়ে করতে চায় গোপীকে। নতুন জীবন শুরু করতে তার মাঝে স্পৃহার কমতি নেই, অসততা নেই। তবে পণের টাকা আদায়ে সে অনুসরণ করে চৌর্যবৃত্তি। বিয়ে ভাঙবার পর হয়ে ওঠে প্রতিশোধপরায়ণ। এরমাঝেই প্রকাশ পেয়েছে আমিনুদ্দি চরিত্রআশ্বিনের ঝড়ে স্ত্রী-সন্তান হারিয়ে যে দ্বীপান্তরী হতে চায়। একে একে এসেছে রাসু, পুত্র ¯েœহের স্বরূপপীতম, কুৎসা রটানো নকুল দাশ ও হিরু জেলে, ভিক্ষা ও চৌর্যবৃত্তির সিধু দাশ। এসেছে কপিলার স্বামী শ্যামদাশের কথা। শারীরিকভাবে সে যেমন শক্ত-সমর্থ, তেমনি চারিত্রিক দিক থেকে প্রকাশ পেয়েছে ঔদ্ধত্য আর অসহিষ্ণু প্রকৃতি। এসেছে যুবক এনায়েতের কথা। দুর্বলের প্রতি অত্যাচারে যার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে মর্মপীড়া। যে ছিল প্রতিবাদী মনের স্বরূপ। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের লেখনিতে যেন প্রাণ পেয়েছে এসকল চরিত্র। লেখক নিয়ে এসেছেন নানান শ্রেণি-পেশার বৈচিত্র্যময় মানুষদের। বলেছেন, পদ্মাপাড়ের গল্পসাবলীলভাবে।
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।