তাঁর জন্মপত্রিকায় নাম লেখা হয়েছিল অধরচন্দ্র, বাবা নাম রেখেছিলেন প্রবোধকুমার যদিও সে নামে তাঁকে চেনে এমন লোকের সংখ্যা নেই বললেই হয়, অথচ বাংলার আপামর মানুষ এক ডাকে চেনে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে, যে নাম তিনি ব্যবহার করেছিলেন তাঁর প্রথম ছাপা গল্পে নেহাৎই খেয়ালের বশে। বাংলার সাহিত্য জগতে তাঁর আবির্ভাব উল্কার মতো। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে বন্ধুদের সঙ্গে তর্কে মেতে তিনদিনের মধ্যে লেখা ‘অতসী মামী’ (১৯২৮) বাংলার পাঠকদের যখন নাড়া দিয়েছিল, তখন বাংলা ছোট গল্পের সম্ভার নেহাৎ ছোট নয় শরৎচন্দ্র মধ্য গগনে, প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে গল্পগুচ্ছের তিন খন্ড তার দুবছর আগে। কাজেই বাংলাসাহিত্যের পাঠককুল রীতিমতো পরিণত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু সেই সব সাহিত্যকদের দলে পড়েন না, যাঁরা একঝলক দমকা হাওয়ার মতো সাড়া ফেলে মিলিয়ে যান। ছত্রিশটি উপন্যাস আর একশো সাতাত্তরটি ছোট গল্প তিনি উপহার দিয়েছেন বাঙালি পাঠককে। প্রতিটি উপন্যাস ঝাঁকুনি দিয়ে ভাঙতে চেয়েছে পাঠকদের ভাবনার নিশ্চিন্ত সুখনিদ্রাকে। চিনিয়ে দিয়েছে আমাদের শঠতা এবং দ্বিচারিতাকে। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’,’পদ্মা নদীর মাঝি’,’দিবারাত্রির কাব্য’,’চতুষ্কোণ’ এমনই এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। তাঁর বিশ্বাস স্থিত ছিল মার্ক্সবাদে, ফ্রয়েডীয় দর্শন তাঁকে প্রভাবিত করেছিল ভীষণভাবে, যার ছাপ রয়েছে তাঁর লেখায়। বাংলা সাহিত্যের দুর্ভাগ্য, লক্ষ্মীর প্রসাদ থেকে তিনি ছিলেন বঞ্চিত। তাই অভাব তাঁকে তাড়া করে ফিরেছে জীবনভোর। যিনি শুধু সাহিত্যের জন্য চাকরি ছেড়েছেন অবহেলায় তিনিই অপরিসীম খেদে বলে ওঠেন -‘দেখো, দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না যায়।’ উল্কার মতোই নিজেকে জ্বালিয়ে খাক করে দিয়ে বাংলা সাহিত্যের আকাশ আলোয় আলোকময় করে তিনি চলে গেলেন অনন্তের সন্ধানে। সম্পূর্ণ বিনা চিকিৎসায়, নিদারুণ অনটনে, মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়েসে শেষ হল তাঁর দিবারাত্রির কাব্য। তাঁর শেষযাত্রায় ফুলের অর্ঘ্যে ভরে গিয়েছিল তাঁর শেষ শয্যা, এক নিষ্ঠুর ঠাট্টার মতো। তিনিও কি বন্ধুর সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলছিলেন তাঁর শেষযাত্রায়- ‘ফুলগুলো সরিয়ে নাও আমার লাগছে। মালা জমে জমে পাহাড় হয় ফুল জমতে জমতে পাথর। পাথরটা সরিয়ে নাও আমার লাগছে।’-সুভাষ মুখোপাধ্যায়
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।