ন হন্যতে মৈত্রেয়ী দেবী লিখিত ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত একটি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। এটির জন্য লেখিকা ১৯৭৬ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। রোমানীয় দার্শনিক মিরচা এলিয়েড লিখিত তাদের সম্পর্ক ভিত্তিক উপন্যাস লা নুই বেঙ্গলীর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ এই উপন্যাসে মৈত্রেয়ী দেবী নিজের বিবৃতি তুলে ধরেছেন।এটি ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লেখা হয়। ১৯৩০ সালে কলকাতায় মৈত্রেয়ী দেবীর বাবা, প্রফেসর সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তর কাছে পড়তে আসেন রোমানিয় মিরচা এলিয়েড। মৈত্রেয়ী দেবীর তখন ১৬ বছর বয়স। মেয়ের বুদ্ধিমত্তায় গর্বিত মৈত্রেয়ী দেবীর বাবা ওনাকে সেই সময় অপেক্ষা সংস্কারমুক্ত শিক্ষার পরিবেশে বড় করেছিলেন। নিজের প্রিয় ছাত্র মিরচা এলিয়েডের সাথে মেয়েকে অধ্যয়ন করতেও উৎসাহিত করেন উনি। মৈত্রেয়ী দেবীর কথায় উনি এবং মিরচা এলিয়েড ছিলেন যেন ওনার বাবার যাদুঘরের দুই প্রিয় নমুনা। এরই মধ্যে মিরচা এবং মৈত্রেয়ী একে অন্যের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। তাদের গুপ্ত ভালবাসা সম্পর্কে অবহিত হবার পর মৈত্রেয়ী দেবীর বাবা মিরচাকে তাঁদের বাড়ী ছেড়ে চলে যেতে বলেন। তাদের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে রোমানিয়নে লেখা মিরচার উপন্যাস মৈত্রেয়ী প্রকাশিত হয় ১৯৩৩ সালে। ১৯৫০ সালে লা নুই বেঙ্গলী নামে ফরাসি ভাষায় অনুদিত হওয়ার অব্যবহিত পড় বইটি চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করে। ১৯৩৮-৩৯ সালে প্রফেসর দাশগুপ্ত ইউরোপ সফরে গিয়ে বইটি সম্পর্কে জানতে পারেন ও দেশে ফিরে মেয়েকে জানান। ১৯৫৩ সালে ইউরোপ সফরকালীন মৈত্রেয়ী দেবীর নাম শুনে কিছু রোমানিয় জানান তারা ওনার সম্বন্ধে বই পড়েছেন। কিন্তু তখনও বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে তাঁর কোনো ধারণা ছিলনা। ১৯৭২ সালে এলিয়েডের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সেরগুই কলকাতায় থাকাকালীন তার কাছ থেকে মৈত্রেয়ী দেবী জানতে পারেন বইতে মিরচা তাঁদের শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে লিখেছেন। এক বন্ধুর সাহায্যে ফরাসি থেকে অনুবাদ করিয়ে উনি বইটি পড়েন ও গভীরভাবে মর্মাহত হন।[৪] ন হন্যতে লেখার মাধ্যমে মৈত্রেয়ী দেবী মিরচা এলিয়েডের কল্পনাপ্রসূত লেখার বিরোধিতা করে জীবনের ওই অধ্যায় সম্বন্ধে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। ১৯৭৩ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৈত্রেয়ী দেবীকে আমন্ত্রণ জানানো হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে বলবার জন্য। উনি এই সময় না জানিয়ে মিরচা এলিয়েডের, যিনি তখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন, দপ্তরে হাজির হন। যে দুই মাস মৈত্রেয়ী দেবী ওখানে ছিলেন, তার মধ্যে দুজনের একাধিকবার দেখা হয়। বইতে মিরচা তাদের শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে যে মিথ্যাচারণ করেছেন তার কারণ জানতে চান উনি। মিরচা কথা দেন মৈত্রেয়ী দেবীর জীবিতকালে তাঁর বইয়ের ইংরাজি অনুবাদ প্রকাশিত হবে না। ১৯৯০ সালে তাঁর মৃত্যুর চার বছর বাদে, ১৯৯৪ সালে লা নুই বেঙ্গলী বেঙ্গল নাইটস নামে ইংরাজিতে প্রকাশিত হয় ইউনিভারসিটি ওফ শিকাগো প্রেস থেকে।
তিনি ১৯১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর তার বাবার কর্মস্থল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ও মায়ের নাম হিমানী মাধুরী রায়। তার বাবা ছিলেন একজন দার্শনিক ও প্রাবন্ধিক। তার শৈশব কাটে বাবার বাড়ি বরিশাল জেলার আগৈল ঝারার গৈলা গ্রামে। ১৯৩৬ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগমায়া দেবী কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি ছিলেন একজন বাঙালি কবি, লেখক ও ঔপন্যাসিক। তার বিখ্যাত আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ন হন্যতে তাকে বিশেষ খ্যাতি এনে দেয়। এই উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৭৬ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। সাহিত্য ছাড়াও সমাজসেবায় অনন্য অবদান রেখেছেন। ১৯৭৭ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ সম্মাননা পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৩৪ সালে তিনি ড. মনোমোহন সেনের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। মনোমোহন সেন ছিলেন একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী। তার সাহিত্যজীবন শুরু ষোল বছর বয়সে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ উদিত ১৯৩০ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ চিত্তছায়া। ১৯৪২ সালে রবীন্দ্রনাথের মংপুতে কাঠানো দিনগুলোর স্মৃতি ও তার সাথে আলাপচারিতা নিয়ে লিখেন স্মৃতিকথা মংপুতে রবীন্দ্রনাথ। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবার্ষিকীতে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি বুলগেরিয়া, হাংগেরী ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যান৷ সোভিয়েট ইউনিয়ন তাঁকে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী পদকে ভূষিত করে। মৈত্রেয়ী দেবী সোভিয়েট ইউনিয়ন, ইউরোপ ও আমেরিকাতে রবীন্দ্রনাথের ওপরে ও শান্তির সমস্যা বিষয়ক বহু ভাষণ দেন। তিনি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তিনি অনাথ শিশুদের জন্য 'খেলাঘর' নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই সংস্থার দেখাশুনা করেন।তিনি ১৯৮৯ সালের ২৯ জানুয়ারী ভারতের কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।