যেসব মনীষী একনিষ্ঠ শ্রম, প্রজ্ঞা, ভাবাদর্শ ও মননশীলতা দিয়ে বৌদ্ধধর্ম, দর্শন ও সাহিত্যকে নানান আঙ্গিকে সমৃদ্ধ করেছেন, অবিস্মরণীয় সেসব ব্যক্তির মধ্যে রয়েছেন মহাকবি অশ্বঘোষ, শূন্যবাদ দর্শনের প্রবক্তা নাগার্জুন, যোগাচারবাদ ও বিজ্ঞানবাদের প্রবক্তা আর্যদেব, অসঙ্গ, বসুবন্ধু, দিঙ্নাগ; অট্ঠকথাচার্য বা ভাষ্যকার বুদ্ধঘোষ, বুদ্ধদত্ত, ধর্মপাল, মহানাম, উপসেন; নৈয়ায়িক ধর্মকীর্তি, তাত্ত্বিক শান্তিদেব, বাঙালির গৌরব অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান এবং টীকা রচয়িতা সারিপুত্র। সৃজন ও বোধের মূর্ত প্রতীক এসব মহামনীষী তাঁদের কালজয়ী সাহিত্যকর্মে নিজেদের প্রকাশ করেননি। তাঁদের সাহিত্যকর্মে তাঁদের জীবনাদর্শ সম্পর্কে পরোক্ষভাবে সংক্ষিপ্ত ও বিক্ষিপ্ত কিছু তথ্য ও তত্ত্ব পাওয়া গেলেও সেই রেখাভাসের মাধ্যমে তাঁদের জীবন-দর্শনের পরিপূর্ণ রসাস্বাদন সম্ভব নয়। কিন্তু পাঠক যখন কোনো লেখকের সাহিত্যপাঠে অভিভূত হন তখন তাঁর ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না-বেদনা এবং জীবনাদর্শের নানান দিক সম্পর্কে জানার তীব্র উৎসাহ বোধ করেন। উপর্যুক্ত সব্যসাচী লেখকগণের ক্ষেত্রে ওই উৎসাহ সুতীব্র হওয়াই স্বাভাবিক। পাঠকের ওই চাহিদা মেটানোর জন্য উল্লিখিত মনীষীদের মৃত্যু-উত্তরকালে প্রাপ্ত ইতিহাস ও জনশ্রুতির আলোকে কিংবা শিষ্য-প্রশিষ্য এবং শ্রুতিপরম্পরায় প্রাপ্ত তথ্যের সাহায্যে তাঁদের জীবনী রচিত হতে দেখা যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় ভারতীয় উপমহাদেশে বৌদ্ধধর্মের অবনতির সঙ্গে সঙ্গে উপরিউক্ত পণ্ডিতদের কালজয়ী সাহিত্যকর্ম ও জীবনচরিতও বাস্তুচ্যুত হয়ে বহির্ভারতে, বিশেষত নেপাল, তিব্বত ও চীনে স্থান করে নেয় এবং ওইসব দেশের ভাষায় অনূদিত হয়ে পঠন-পাঠন ও চর্চা হতে থাকে। সংস্কৃত ও পালি ভাষায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেলেও এসব মহামনীষীর অনেক গ্রন্থের মূল পাঠ যেমন অনাবিষ্কৃত, তেমনি অধিকাংশ গ্রন্থ তিব্বতি ও চৈনিক ভাষায় সংরক্ষিত হওয়ায় অন্যান্য ভাষার মানুষের নিকট তা দুর্জ্ঞেয়। ফলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এসব সব্যসাচী লেখকের সাহিত্যকর্ম ও জীবনাদর্শের রস আস্বাদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যুগের বিবর্তনে এই মহামহিম বিদগ্ধ বৌদ্ধ পণ্ডিতদের জীবনচরিত ও সাহিত্যকর্ম বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থী ও গবেষকদের কাছে বিস্মৃতপ্রায়। বর্তমানে চৈনিক ও তিব্বতি তথ্যসমূহ ইংরেজি এবং বিভিন্ন উন্নত দেশের ভাষায় অনুবাদ হওয়ার কারণে উপর্যুক্ত ঋদ্ধ মনীষীদের মনোজ্ঞ ও বর্ণিল জীবন এবং কালজয়ী সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও তত্ত্ব পাওয়া যাচ্ছে। বহুমাত্রিক গুরুত্বের কারণে বহির্বিশ্বে এসব মনীষীর জীবন ও সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে গবেষণা সোৎসাহে চললেও বাংলাদেশে বিক্ষিপ্ত কিছু গবেষণা ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা হয়নি। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে তথ্যাভাব। আলোচ্য গ্রন্থটি অনুসন্ধিৎসু গবেষক, সাহিত্যানুরাগী পাঠক ও ছাত্র-ছাত্রীদের বিস্মৃত সেই প্রাচীন কীর্তিমান বৌদ্ধ পণ্ডিতদের বৈচিত্র্যময় জীবন ও কর্মের নানান দিক সম্পর্কে ধারণা দিতে সক্ষম হবে এবং গবেষকগণ গ্রন্থটির সূত্র ধরে আলোচ্য পণ্ডিতদের জীবন-কীর্তি ও দর্শন সম্পর্কে আরও নতুন তথ্য ও তত্ত্ব উদ্ঘাটনে ব্রতী হবেন বলে প্রত্যাশা রাখি।
Dr.Dilip Kumar Barua, জন্ম (৩১ ডিসেম্বর ১৯৬৭) চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনীয়া থানার শিলক গ্রামে। পিতা নিরোদ বরন বড়–য়া, মাতা পারিকা বড়–য়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে বি.এ সম্মান ও এম.এ ডিগ্রি লাভ; ১৯৯৫ সালে সংস্কৃত ও পালি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান; ২০০০ সালে জাপানের আইচি গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন এবং ২০০২ সালে জাপান সরকারের জেএসপিএস স্কলারশিপে পোস্ট-ডক্টরেট গবেষণা সমাপ্ত করেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ : বৌদ্ধধর্ম (১৯৯৭), উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়; Syncretism in Bangladeshi Buddhism (2002), Nagoya, Japan; গন্ধবংস (২০০৫), আজকাল প্রকাশনী, ঢাকা; বৌদ্ধরঞ্জিকা (২০০৫), নবযুগ প্রকাশনী, ঢাকা; সদ্ধম্ম-সংগহো (২০০৭), পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; কীর্তিমান বৌদ্ধ সাহিত্যিক ও দার্শনিক (২০০৮), পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; বুদ্ধঘোসুপ্পত্তি (২০০৮), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থা, ঢাকা এবং পালি ভাষার ইতিবৃত্ত (২০১০), বাংলা একাডেমী, ঢাকা। এছাড়াও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গবেষণা জার্নালে ডক্টর বড়–য়ার ৩৫টির অধিক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, নেপাল ও ভারতে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগদান ও গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক এবং চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত।