কুরআন-সুন্নাহ শরিয়তের বিধানসমূহ প্রমাণিত হওয়ার মূলভিত্তি হওয়ার ব্যাপারে যেমন সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই, ঠিক তেমনি শরিয়তের বিধানসমূহের মধ্যে অনেক হিকমত ও তাৎপর্য নিহিত রয়েছে—এতেও কোনো সন্দেহ নেই। উল্লেখ্য, যদিও শরয়ি বিধান যথার্থ প্রমাণিত হওয়ার জন্য এসব হিকমত ও তাৎপর্যের ওপর নির্ভরশীল নয়, তথাপি এগুলোর মধ্যে এ বৈশিষ্ট্য অবশ্যই রয়েছে। একশ্রেণির মানুষের জন্য এসকল হিকমত জানা থাকা শরিয়তের বিধানের ক্ষেত্রে অধিক নিশ্চয়তা ও সান্তনা সৃষ্টির জন্য একটা পর্যায় পর্যন্ত বেশ সহায়ক হয়। (বর্তমানে এরূপ দুর্বল প্রকৃতির লোকের সংখ্যাই বেশি)। যদিও মজবুত ঈমানদারদের জন্য এর প্রয়োজনীয়তা নেই। এ কারণেই অনেক ওলামায়ে কেরাম, যেমন : ইমাম গাজালি, আল্লামা খাত্তাবি, ইমাম ইবনে আবদুস সালাম প্রমুখ মনীষীগণের রচনাবলিতে এ ধরনের সূক্ষ্মতত্ত্ব ও নিগূঢ় রহস্য পরিলক্ষিত হয়। হাল জমানায় আমাদের সমাজে আধুনিক শিক্ষার প্রভাবে মানুষের স্বভাব-চেতনায় যে স্বাধীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাতে অনেকের মধ্যে শরিয়তের বিধানসমূহের কল্যাণ ও উপকারিতার হিকমত ও তাৎপর্য বিশ্লেষণে আগ্রহ ও প্রেরণা সৃষ্টি হয়েছে। যদিও এ আগ্রহকে দমন করে দেয়াটাই ছিল এর প্রকৃত চিকিৎসা (কারণ, অনেক ক্ষেত্রে এ আগ্রহ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়)। কিন্তু অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, প্রকৃত সত্যান্বেষী ব্যতীত সাধারণ লোকজনকে এটা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেয়া হতাশ হওয়া ছাড়া কিছুই নয়। তাই সংকট মোচন ও সাধারণ মানুষের সহজসাধ্যের প্রতি লক্ষ করে কতিপয় বিজ্ঞ আলেম এ বিষয়ে বক্তৃতা ও লেখালেখির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এ বিষয়ে কিছুকাল পূর্বে হজরত মাওলানা শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি রহ. হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা নামক সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেছেন। কিন্তু এর বিষয়বস্তু বেশ নিগূঢ় তত্ত্বসমৃদ্ধ হওয়ায় সাধারণ মানুষের উপযোগী নয়। তাই সর্বসাধারণের বোধগম্য ভাষায় বুদ্ধিবৃত্তিক ও যৌক্তিকতার আলোকে ইসলামের বিধানাবলির তাৎপর্য নিয়েই রচিত এই বইটি। লিখেছেন বিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত আলেম মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ.।
হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী, ভারতীয় উপমহাদেশ এবং এর গন্ডি পেরিয়ে যিনি হাজারো মানুষকে দিয়েছেন আত্মশুদ্ধি ও তাসাওউফ এর শিক্ষা। যার কারণে তাঁর উপাধি ছিলো ‘হাকীমুল উম্মাত’ বা উম্মাহর আত্মিক চিকিৎসক। উপমহাদেশে মুসলমানদের মাঝে সুন্নতের জ্ঞান প্রচারে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ‘দাওয়াতুল হক’ এর অবদানের জন্যও প্রসিদ্ধ মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর নাম। মাওলানা আশরাফ আলী থানভী ১৯ আগস্ট, ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে (রবিউস সানী ৫, ১২৮০ হিজরী) ভারতের উত্তর প্রদেশের থানাভবনে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই হাফেয হোসাইন আলী রাহ.-এর কাছে সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর শিক্ষাজীবন। নিজগ্রামেই ছোটবেলায় হযরত মাওলানা ফতেহ মুহাম্মদ থানভী রাহ.-এর কাছ থেকে আরবি ও ফার্সি ভাষার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১২৯৫ হিজরীতে তিনি দারূল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের উচ্চতর শাখাগুলোয় বিচরণ করার আগ্রহে। সেখানে তিনি পাঁচ বছর হাদীস, তাফসীর, আরবি সাহিত্য, ইসলামী দর্শন, যুক্তিবিজ্ঞান, ইসলামি আইন এবং ইতিহাস বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। দেওবন্দে শিক্ষার অধ্যায় সমাপ্ত করে মক্কা মুকাররমায় মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ্ মুহাজিরে মক্কীর কাছে কেরাত ও তাজবীদ শেখেন। তিনি কানপুরের একটি মাদ্রাসায় মাত্র ২৫ টাকা বেতনে শিক্ষকের পদ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে কানপুরের টপকাপুরে জামিউল উলূম মাদ্রাসার প্রধান পরিচালকের আসন অলংকৃত করেন এবং দীর্ঘ ১৪ বছর সেখানে শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে তাঁর শিক্ষক হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কীর রহ. পরামর্শে তিনি থানা ভবনের খানকাহে ইমদাদিয়ায় অবস্থান গ্রহণ করেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। সারা জীবনে আশরাফ আলী থানভী এর সকল বই এর হিসেব করতে গেলে ছোট-বড় মিলিয়ে তা সাড়ে বারো হাজার ছাড়িয়ে যায়। হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. এর বই সমূহ এর মধ্যে ফিকাহ বিষয়ক বই ‘বেহেশতী জেওর’ উপমহাদেশের মুসলমানদের মাঝে বহুল পঠিত। এছাড়া তাঁর রচিত কুরআন শরীফের উর্দু তরজমার গ্রন্থ বয়ানুল কুরআনও (কুরআনের ব্যাখ্যা) এর ভাষা ও ব্যখ্যাশৈলীর জন্য প্রসিদ্ধ। হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. এর বই সমগ্র এর স্বত্ত্ব তিনি জাতির কল্যাণে উন্মুক্ত করে রেখে গেছেন। জুলাই ১৯, ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে (১৬ রজব, ১৩৬২ হিজরী) আল্লামা থানভী রহ. তাঁর জন্মস্থান থানা ভবনেই মৃত্যুবরণ করেন।