বাংলা সাহিত্যে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরপরিবারের মতো আরএকটি বিখ্যাত পরিবার আছে। সেই পরিবারটি পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ জেলার। রায়চৌধুরী পরিবার। পরে অবশ্য অনেকেই রায়চৌধুরী না লিখে শুধু রায় লিখেছেন। এঁদের প্রথম পুরুষ যিনি সাহিত্য রচনায় সর্বপ্রথম খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তার নাম উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। তার এক পুত্র সুকুমার রায় আর দু কন্যা সুখলতা রাও ও পুণ্যলতা চক্রবর্তী বাংলা শিশুসাহিত্যে অক্ষয় কীর্তির অধিকারী। এই পরিবারেরই সন্তান এবং সুকুমার রায়ের পুত্র সত্যজিৎ রায় পৃথিবীতে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নতুন এক যুগ সৃষ্টি করেছেন; সত্যজিৎ শিশুকিশোরদের জন্য সাহিত্য রচনাও কম করেন নি। যে-বৎসর রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পান সে-বছরেই ১৯১৩ সালে উপেন্দ্রকিশোর ছোটদের জন্য একটি পত্রিকা বের করেন, তার নাম রেখেছিলেন ‘সন্দেশ। বাংলা শিশুসাহিত্যে নতুন যুগ সৃষ্টি করেছিল ‘সন্দেশ। তার লেখা যে-বই একসময় বাংলা দেশের ঘরে ঘরে ছেলেমেয়েরা পড়ত সেটি হল ‘টুনটুনির বই। আমরা যে এখন সত্যজিৎ রায়ের তৈরি ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’ সিনেমা দেখি সেটি তাঁর পিতামহ উপেন্দ্রকিশোরেরই রচনা। ছেলেদের রামায়ণ’, ‘ছেলেদের মহাভারত’ আর ‘মহাভারতের গল্প’ তার লেখা অত্যন্ত সুখপাঠ্য রচনা; ছেলেমেয়েরা ছোট থাকতেই তার নিজের দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও সবচেয়ে বিখ্যাত দুটি মহাকাব্যের গল্পগুলো যাতে জানতে পারে তার জন্য এ তিনটি বই তিনি লিখেছিলেন। ‘মহাভারত'-এর মতো বই সারা পৃথিবীতে আর একটিও লেখা হয় নি, এ-সংবাদ আমরা অনেকেই জানি না। বাংলা দেশে গ্রামে-গঞ্জে, পল্লী-অঞ্চলে, লোকের মুখে মুখে যে-গল্প চালু হয়েছে ছোটদের ঘুমপাড়ানি গল্পের আবদারে, সেগুলোর দিকে প্রথম নজর দেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তারই পরামর্শ মেনে সে-সব জোগাড় করে লিখতে ও ছাপাতে শুরু করেন উপেন্দ্রকিশোর। লিখিত রূপে না থাকলে কোনো কিছুই পরের যুগ পর্যন্ত পৌঁছায় না। বাংলা দেশের লোকগল্পগুলোকে এভাবেই চিরস্থায়ী রূপ দিয়ে যান তিনি। ‘বাঘখেকো শিয়ালের ছানা’ কি ‘ভূতো আর, ঘোতে’ বা ‘টুনটুনি আর। নাপিতের কথা কিংবা এ-জাতীয় আরো বহু ছেলেভুলানো গল্প আমরা এখন জানতেই পারতাম না তিনি যদি না লিখে রাখতেন। উপেন্দ্রকিশোরকে আমরা এখনও মনে রেখেছি তার লেখা শিশুসাহিত্যের জন্য, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ এসব রচনা আজও আমরা মহানন্দে পড়ে থাকি। কিন্তু তার কৃতিত্ব আরও এমন কিছু দিকে রয়েছে যার কারণে তিনি এদেশে মুদ্রণশিল্পের ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি খুব ভালো ছবি আঁকতে পারতেন। তার নিজের লেখায় ছবি থাকলে সেগুলো অন্যকে দিয়ে না আঁকিয়ে তিনি নিজেই আঁকতেন। সে-সব দিনে পত্রিকায় বা গ্রন্থাদিতে ছবি ছাপার তেমন সুব্যবস্থা ছিল না। তিনি উৎসাহী হয়ে এ ব্যাপারে গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন এবং ব্লক তৈরি ও প্রিন্টিংয়ের নানা দিকে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এ ছাড়া তাঁর খ্যাতি গানবাজনার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট ছিল। তিনি কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র অতি উত্তমরূপে শিক্ষা করেছিলেন। পাখোয়াজ হার্মোনিয়াম সেতার বাশি ও বেহালা বাজানোয় তার সুখ্যাতি ছিল। তিনি এ বিষয়ে বইও রচনা করেছিলেন, যেমন ‘বেহালা শিক্ষা’ বা ‘হার্মোনিয়াম শিক্ষা’। সে-আমলে কলকাতায় বাদ্যযন্ত্র তৈরির বিখ্যাত এক কোম্পানি ছিল ডোয়ার্কিন, তাদের প্রকাশিত ‘সঙ্গীত-প্রকাশিকা' পত্রিকার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। উপেন্দ্রকিশোরের জন্ম ১৮৬৩ সালে এবং তিনি ১৯১৫ সালে লোকান্তরিত হন।
উপেন্দ্রকিশোরের জন্ম ১২৭০ বঙ্গাব্দের ২৭শে বৈশাখ (১৮৬৩ সালের ১০ই মে) ময়মনসিংহ জেলার মসূয়া গ্রামে, যা অধুনা বাংলাদেশে অবস্থিত। তাঁর পিতা কালিনাথ রায় ছিলেন সুদর্শন ও আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃতে সুপণ্ডিত। তাঁর ডাকনাম ছিল শ্যামসুন্দর মুন্সী। উপেন্দ্রকিশোর শ্যামসুন্দরের আটটি সন্তানের মধ্যে তৃতীয় পুত্রসন্তান। তাঁর পৈতৃক নাম ছিল কামদারঞ্জন রায়। পাঁচ বছরেরও কম বয়সে তাঁর পিতার অপুত্রক আত্মীয় জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী তাঁকে দত্তক নেন ও নতুন নাম দেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। মেধাবী ছাত্র বলে পড়াশোনায় ভাল ফল করলেও ছোটোবেলা থেকেই উপেন্দ্রকিশোরের পড়াশোনার থেকে বেশি অনুরাগ ছিল বাঁশী, বেহালা ও সঙ্গীতের প্রতি। ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে উপেন্দ্রকিশোর প্রবেশিকা পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তি পান। তারপর কলকাতায় এসে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সী কলেজে। ১৯১৫ সালের ২০শে ডিসেম্বর মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে উপেন্দ্রকিশোর পরলোক গমন করেন।