"কিরীটী অমনিবাস (১৫তম খণ্ড)" বইটির সম্পর্কে কিছু কথা: ‘সামনে সমুদ্র নীল’ কাহিনীতে কিরীটী যেন হত্যাকারী ও প্রেমিকের মাঝখানে জীবনের আতঙ্কময় রহস্য দেখছে, সে সরিৎশেখর ও অনুরাধার মাঝখানের ঘরে। অনুরাধা বাস করেছে। তার হত্যাকারীকে নিয়ে। প্রেমিক সরিশেখরের হৃদয় হত্যাময় প্রেমের উজ্জ্বলতায় ধাবিত কিরীটীর ঘর পেরিয়ে, আর হত্যাকে বুকে নিয়ে সরিতের কাছে মুক্তি চায় তার প্রেমের পাত্রী কিরীটীর ঘর পেরিয়ে। এই সিচুয়েশনই আরও রহস্যময় ও জটিল হয়েছে কিরীটীর ঘরে পূর্বে নিহত জীমূতবাহনের ভয়ংকর অনুষঙ্গ, এর আবহাওয়ার মধ্যে হত্যা ও পাপ, তাকে প্রত্যক্ষ করে তুলেছে ছদ্মবেশী চন্দ্রকান্ত ঘাই, ক্ষিতীন্দ্র-রূপে যার মৃতদেহ তারই স্ত্রী সনাক্ত করেছিল। ক্ষিতীন্দ্রের এ জগতে বেঁচে থাকাটাই যেন অপরাধ, এই অপরাধ থেকে মুক্তির জন্যেই তার মৃত্যু অনিবার্য—এবং অপরিহার্য নিয়তি। কাহিনীর শেষে সলিল দত্ত মজুমদারের—যে তিনটি হত্যার জন্যে দায়ী—হাে হাে করে হাসি কি সাম্প্রতিক যুগের ও জীবনের প্রতি তুচ্ছতার প্রতীক, তার নিজের জীবনই হাসির মত তুচ্ছ? ‘মানসী তুমি’ কাহিনীর সিচুয়েশন আরও গাঢ়তর ; নাটকীয় অপ্রত্যাশিত কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। মানসীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের অপূর্ব মহীয়সী রূপ প্রথমে শরদিন্দুর কাছে ধরা দিয়েছে; সেই মানসীরই যখন বিবাহ হয়েছে শরদিন্দুর সঙ্গে, সুকুমারের সঙ্গে একই বাড়িতে বাস করছে, স্বামীর সন্দেহের ও ঈর্ষার জ্বালায় নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলেছে, তখন তার চেহারা অন্য রকম। সামাজিক সংস্কার ও প্রেম ; দুই ভাই, একজন স্বামী, অন্যজন প্রেমিক ; স্বামী ঐশ্বর্যশালী ও বিত্তবান, প্রেমিক পরাশ্রয়ী প্রেমভীরু দুর্বল ; এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে মানসী জর্জরিত। এই নাটকীয় সিচুয়েশান থেকেই সুকুমারের প্রেম প্রতিহিংসায় রূপান্তরিত হয়েছে; চোখের সামনে সে দেখতে পারে না তারই প্রেমিকার দেহ ভােগ করছে অন্য পুরুষ ;তাই প্রেমিকাকে হত্যা করবার সংকল্প নেয়। এবং কাহিনীর শেষে মৃত্যু থেকে ফিরে এসে মানসী যখন সুকুমারের হাতে আবার মারা পড়তে গিয়েও কিরীটীর জন্য বেঁচে শেষ পর্যন্ত নিরুদ্দেশ হয়ে যায় স্বামীর কাছে ফিরে না এসে—তখন পাঠকের মনে অনেক প্রশ্ন জাগে—সে কি সুকুমারকে হত্যার মামলা থেকে বাঁচাবে, না প্রেমকে বড় করে দেখেছে বলে সুকুমারের এই দৃশ্য সইতে না পেরে নিরুদ্দেশ হয়েছে ব্যর্থ হতাশায়, নতুবা সে নিজেই নিজেকে মারবে? এই বিভিন্ন প্রশ্নাকুলতাই এই কাহিনীর সার্থকতা।
বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র কিরীটি রায় এর স্রষ্টা এবং জনপ্রিয় রহস্য কাহিনী লেখক ডাঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত শুধু একজন সাহিত্যিকই ছিলেন না, একইসাথে ছিলেন একজন চিকিৎসকও। একজন ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক হিসেবে দুই বাংলাতেই লাভ করেছেন বিশেষ পাঠকপ্রিয়তা। ওপার বাংলায় বেড়ে ওঠা ও জীবন কাটালেও তিনি জন্মেছিলেন এপার বাংলায়। নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার ইটনায় ১৯১১ সালের ৬ জুন বিখ্যাত কবিরাজ বংশীয় পরিবারের সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন এই প্রখ্যাত কাহিনীকার। পিতার বদলির চাকরির সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় পড়াশোনা করতে হয়েছে । শেষ পর্যন্ত কোন্নগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ও কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করার পর তিনি কলকাতার কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেন ও চর্মরোগ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন লন্ডন থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তিনি ডাক্তার হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং বিভিন্ন দেশের রণাঙ্গনে ঘুরে ঘুরে সেবাদানের পাশাপাশি বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন, যার ছাপ পরবর্তীতে পড়েছে নীহাররঞ্জন গুপ্ত এর বই সমূহতে। নীহাররঞ্জন গুপ্তের বই লেখার ইচ্ছা ছোটবেলা থেকেই এবং সেই সূত্রে তিনি অনেক কম বয়সেই তাঁর প্রথম উপন্যাস 'রাজকুমার' রচনা করেন। তবে নীহাররঞ্জন গুপ্তের উপন্যাস এর মধ্যে তাঁকে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে তাঁর লেখা গোয়েন্দা উপন্যাস সমূহ, যা রচনা করার আগ্রহ থেকে তিনি ব্রিটেনে অবস্থানকালে সাক্ষাৎ করেন আরেক বিখ্যাত গোয়েন্দাকাহিনী রচয়িতা আগাথা ক্রিস্টির সাথে। নীহাররঞ্জন গুপ্তের গোয়েন্দা গল্প এর মধ্যে প্রথমটি হলো 'কালোভ্রমর', যেখানে তিনি সকলকে পরিচয় করিয়ে দেন তাঁর সেরা সৃষ্টি গোয়েন্দা কিরীটি রায়ের সঙ্গে। এছাড়াও নীহাররঞ্জন গুপ্তের রচনাবলী এর মধ্যে 'মৃত্যুবাণ', 'কালনাগ', 'উল্কা', 'হাসপাতাল', অপারেশন', 'কিরীটি অমনিবাস' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। নীহাররঞ্জন গুপ্তের বই এর সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক। আর নীহাররঞ্জন গুপ্ত এর বই সমগ্র এর মধ্যে প্রায় ৪৫টি নিয়ে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। এছাড়াও তিনি 'সবুজ সাহিত্য' নামে শিশু-কিশোর উপযোগী সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এই বিখ্যাত সাহিত্যিক ৭৪ বছর বয়সে ১৯৮৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।