এক ফাঁকা মাঠের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা কাঁচা সড়ক চলে গেছে। এদেশে বলে ‘কাচ্চী’। গোটা কাচ্চী জুড়ে গভীর আঁচড়ের মতো একটানা এলোপাথারি গর্ত। বারো মাস এই রাস্তায় বয়েল আর ভৈসা গাড়ি চলে। এগুলো তারই দাগ। দু ধারে মাইলের পর মাইল পাথর-মেশানো পড়তি জমি। যতদূর তাকানো যায় কোথাও একটা ধানের শিষ চোখে পড়ে না। তবে শস্যহীন নিষ্ফলা কর্কশ মাটি ফাটিয়ে বেরিয়ে এসেছে সর্বন ঘাস, সাবুই ঘাস, শরের ঝোপ। সর্বন পাতার সুঘ্রাণ হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। এখানে ওখানে ফুটে আছে থোকায় থোকায় সফেদিয়া আর মনরঙ্গোলি ফুল। এইসব আগাছা আর ফুলের জীবনীশক্তি বড় প্রবল। নইলে রুক্ষ পাথুরে মাটির রস শুষে টিকে আছে কি করে ? কাঁচা মেঠো রাস্তায় হাঁটুভর লালচে ধুলো মাড়িয়ে মাড়িয়ে এগিয়ে চলেছে ধানোয়ার। বয়েস চল্লিশ বেয়াল্লিশ। বাজপড়া ঢ্যাঙা তালগাছের মতো চেহারা। দুলা কমজোরি শরীরে মাংস বলতে বিশেষ কিছু নেই ; সবই প্রায় হাড়। রোদে জ্বলে জ্বলে গায়ের রঙ তামাটে। ফাটা পা, খসখসে চামড়া থেকে খই উড়ছে। মুখে খাপচা খাপচা দাড়ি। পরনে তালিমারা চিটচিটে খাটো ধুতি আর বহুকালের পুরনো জামা। কাঁধে একটা ঝুলি। তার ভেতর রয়েছে ধানোয়ারের যাবতীয় পার্থিব সম্পত্তি—বাঁদরার ছাই (একরকম ক্ষার) দিয়ে কাচা দুটো কাপড়, দুটো জামা, একটা ধুসো কম্বল, কিছু বাজরার ছাতু, খানিক মকাই, সুখনি (এক ধরনের কন্দ), সিলভারের তোবড়ানো একটা থালা, পেতলের লোটা, ধারাল দা আর একটা টাঙ্গি। বছর দুই আগে এক আদিবাসী মুণ্ডার কাছ থেকে আড়াই টাকায় টাঙ্গিটা কিনেছিল ধানোয়ার। সেটার ঝকঝকে ফলা ঝুলির বাইরে বেরিয়ে আছে।
তিনি অবিভক্ত ভারতের পূর্ব বাংলার (অধুনা বাংলাদেশ) ঢাকা জেলায়, বিক্রমপুরের আটপাড়া গ্রামে ১১ ই সেপ্টেম্বর, ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহন করেন, স্বাধীনতার পর ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে ভারতে চলে আসেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস 'পূর্ব পার্বতী' (১৯৫৭)। উপন্যাস রচনার জন্য তিনি সারা জীবন অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। 'সিন্ধুপারের পাখি'র জন্য ১৯৫৮ তে পেয়েছেন পুরস্কার, 'ক্রান্তিকাল' এর জন্য ২০০৩ এ অকাদেমি পুরস্কার। প্রফুল্ল রায় এর উদ্বাস্তু জীবনকেন্দ্রিক যে সমস্ত উপন্যাসগুলি রচিত সেগুলি হল ‘কেয়াপাতার নৌকা’ (২০০৩), ‘শতধারায় বয়ে যায়’ (২০০৮), ‘উত্তাল সময়ের ইতিকথা’ (২০১৪), ‘নোনা জল মিঠে মাটি’ (বাং ১৩৬৬)। ‘কেয়াপাতার নৌকা’, ‘শতধারায় বয়ে যায়’, ‘উত্তাল সময়ের ইতিকথা’ আকারে এবং নামে আলাদা হলেও আসলে তিনটি উপন্যাস মিলেই একটি উপন্যাস, ‘কেয়াপাতার নৌকো’র পরবর্তী খণ্ড ‘শতধারায় বয়ে যায়’ এবং তারও পরবর্তী খণ্ড ‘উত্তাল সময়ের ইতিকথা’। তিনটি উপন্যাসই আকারে মহাকাব্যিক। অসামান্য ক্ষমতা সম্পন্ন এইঔপন্যাসিক সারা জীবন জুড়ে পুরস্কারও পেয়েছেন প্রচুর। 'সিন্ধু পারের পাখি'র জন্য ১৯৮৫ তে 'বঙ্কিম পুরস্কার', 'ক্রান্তিকাল' উপন্যাসের জন্য ২০০৩ এ পেয়েছেন 'সাহিত্য অকাদেমি' পুরস্কার, এছাড়াও 'রামকুমার ভুয়ালকা', পাবলিশার্স এন্ড বুক সেলার্স গিল্ড এর 'লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট', 'শরৎস্মৃতি', 'বি কে জে এ' ইত্যাদি সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। তার গল্প উপন্যাস অবলম্বনে রচিত হয়েছে ৪৫টির মতো টেলিফিল্ম, টেলি-ধারাবাহিক, ফিচার-ফিল্ম। 'মোহনার দিকে' অবলম্বনে 'মোহনার দিকে' (১৯৮৪), 'আদমি আউ আউরত' (১৯৮৪), 'একান্ত আপন'(১৯৮৭), 'চরাচর'(১৯৯৪), 'টার্গেট' (১৯৯৭),'মন্দ মেয়ের উপাখ্যান' (২০০৩), 'ক্রান্তিকাল'(২০০৫) ইত্যাদি উল্ল্যেখযোগ্য। 'মন্দ মেয়ের উপাখ্যান 'Best ASEAN film Award', 'Netpac Award', ও 'Golden Lotus Award'পায়। 'ক্রান্তিকাল' পায় 'Indian compitional Special Mention' পুরস্কার।