এবার প্রকাশিত হল প্রখ্যাত সাহিত্যিক সমরেশ বসু রচিত ‘গোয়েন্দা অশোক ঠাকুর সমগ্র”-এর তৃতীয় খণ্ড ৷ এখানে স্থান পেয়েছে মোট ছ'টি উপন্যাস। প্রথম উপন্যাস ‘অন্দর মহল'-এ গোয়েন্দা অশোক ঠাকুরের কীর্তি পূর্বের দুই খণ্ডের কাহিনীগুলির মতোই এক কথায় অ-সাধারণ। এরপর আর পাঁচটি উপন্যাসে গোয়েন্দা অশোকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আর একজন কিশোর গোয়েন্দা গোগোল যার কীর্তি-কাহিনীও কম বিস্ময়কর নয়। পাঁচটি উপন্যাসে অশোক ও গোগোলের যুগ্মতায় রচিত হয়েছে এক একটি শ্বাসরুদ্ধকর রহস্য ও অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী। পুরীর পটভূমিকায় দারুণ রহস্যময় পরিস্থিতির ভিতর সময়ের ব্যবধানে গড়ে উঠেছে দুটি কাহিনী——সোনালী পাড়ের রহস্য’ ও ‘ভুল বাড়িতে ঢুকে’। এছাড়া দীঘার পটভূমিতে “গোগোল কোথায়' এবং মধুপুরের পটভূমিতে ‘গোগোলের কেরামতি'। দিল্লি থেকে ফেরার পথে ‘রাজধানী এক্সপেসে হত্যা রহস্য'-এর সমাধান কী নিদারুণ কৌশলে অশোক ও গোগোল মিলে সম্পন্ন করল তা কাহিনীগুলি এক নিশ্বাসে না পড়লে বিশ্বাসই করা যায় না । সমরেশ বসুর দুর্দান্ত শক্তিশালী কলমের আঁচড় প্রতিটি উপন্যাসের প্রতি পাতায় এমন বিশ্বস্ত ভঙ্গিতে ফুটে উঠেছে যে দু'জন গোয়েন্দার দু'রকম অভিজ্ঞতা বর্তমান গ্রন্থটিকে এক ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছে।
সমরেশ বসু (১৯২৪-১৯৮৮) প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি লেখক, ঔপন্যাসিক। কালকূট ও ভ্রমর তার ছদ্মনাম। তার রচনায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, শ্রমজীবী মানুষের জীবন এবং যৌনতাসহ বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সুনিপুণ বর্ণনা ফুটে ওঠে। ১৯৮০ সালে তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। তার শৈশব কাটে বাংলাদেশের বিক্রমপুরে আর কৈশোর কাটে কলকাতার উপকণ্ঠ নৈহাটিতে। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতায় তার জীবন ছিল পরিপূর্ণ। এক সময় মাথায় ফেরি করে ডিম বেচতেন। বিচিত্র বিষয় এবং আঙ্গিকে নিত্য ও আমৃত্যু ক্রিয়াশীল লেখকের নাম সমরেশ বসু। দেবেশ রায় তাঁর মৃত্যুতে লেখা রচনাটির শিরোনামই দিয়েছিলেন, 'জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি লেখক এবং পেশাদার লেখক'। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি ইছাপুরের গান ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। ট্রেড ইউনিয়ন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। এ কারণে তাকে ১৯৪৯-৫০ সালে জেলও খাটতে হয়, জেলখানায় তিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ’ রচনা করেন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। কালকূট মানে তীব্র বিষ। এটি তাঁর ছদ্মনাম। 'অমৃত কুম্ভের সন্ধানে', 'কোথায় পাব তারে' সহ অনেক উপন্যাস তিনি এ নামে লিখেছেন। বহমান সমাজ থেকে বাইরে গিয়ে একান্তে বেড়াতে ঘুরে বেরিয়েছেন আর সে অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ভ্রমণধরমী উপন্যাস । হিংসা, মারামারি আর লোলুপতার বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে যে জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল, সেখান থেকে বেড়িয়ে এসে অমৃতের সন্ধান করেছেন । তাই কালকূট নাম ধারণ করে হৃদয়ের তীব্র বিষকে সরিয়ে রেখে অমৃত মন্থন করেছেন উপন্যাসের মধ্য দিয়ে৷ “অমৃত বিষের পাত্রে”, “মন মেরামতের আশায়”, 'হারায়ে সেই মানুষে', 'তুষার শৃঙ্গের পদতলে' ইত্যাদি এই ধারার উপন্যাস। ছদ্ম নামে লেখা শাম্ব উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৮০ সালের আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। লেখক হিসেবে সমরেশ আমৃত্যু যে লড়াই করেছেন তার কোনো তুলনা নেই। তাঁর নিজের জীবনই আরেক মহাকাব্যিক উপন্যাস। 'চিরসখা' নামের প্রায় ৫ লাখ শব্দের বিশাল উপন্যাসে সেই লড়াইকে স্মরণীয় করে রেখেছেন তারই পুত্র নবকুমার বসু। ছোটদের জন্যে সৃষ্ট গোয়েন্দা গোগোল অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। গোগোলকে নিয়ে বহু ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেছেন যা শিশুসাহিত্য হিসেবে সমান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গোগোলের দুটি কাহিনী চলচ্চিত্রায়িতও হয়।