'কাহাকে' বই নিয়ে কিছু কথা: উনিশ শতকের শেষলগ্নে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজা দিদি রচনা করলেন 'কাহাকে'(১৮৯৮) সাল তারিখ এর হিসেব বলে স্বর্ণকুমারী র উপন্যাস রচনার আগেই প্রকাশিত হয়েছিল হেমাঙ্গিনী দেবী বা নবীনকালী দেবীর উপন্যাস। তবু বাংলার নারী ঔপন্যাসিকদের সারণিতে প্রথমার গৌরব স্বর্ণকুমারী দেবীর ই প্রাপ্য। বাংলার তাঁর মতো বহুপ্রসূ লেখনী তাঁর সমকালে আর কোনো নারী সাহিত্যিকের যেমন ছিল না, তেমনি ছিল না তাঁর মতো ধারাবাহিতার যোগ্যতা। বাংলার নারী ঔপন্যাসিকদের প্রবহমান তার গঙ্গা ধারায় তিনিই প্রথম ভগীরথ -প্রথম পুরোগামিনী পথিকৃৎ। উনিশ শতকের সময় পরিধিতে তাঁর শেষ উপন্যাস 'কাহাকে'।উপন্যাস জুড়ে রয়েছে নায়িকা মণি বা মৃণালিনীর আত্মকথন। উত্তম পুরুষে সে ই শুনিয়েছে তাঁর 'সকল দিনের পথ খোঁজা'আর তা সাঙ্গ হওয়ার কাহিনি।কাহাকে ভালোবাসে খঁজে ফিরেছে সে সেই সত্যটি। ভালোবাসার বর্ণবিভা-ই এ উপন্যাসের একমাত্র বিষয়।সেই বর্ণবিচ্ছুরনে মিশে আছে কত রঙের স্তরবিন্যাস,কত বিচিত্র শেড -এক জীবনের ভালোবাসায় তো কত জন্ম-জন্মান্তরই ঘটে মানুষের। নিতান্ত শৈশবে মণি ভালোবাসত তার বাবাকে, ভালোবাসত সর্দার পোড়ো ছোটুকেও কিন্তু বুঝেই উঠতে পারত না কাকে বেশি কাকে ভালোবাসে।ছোটুকে ঘিরে মণির শৈশবের এই ভালোবাসায় সুর লেগেছিল ছোটুর গলার একটি গানে--'হায়!মিলন হোলো/যখন নিভিল চাঁদ বসন্ত গেলো'।এই একটি গান চিরদিন রয়ে গেল মণির ভালোবাসার উদ্দীপন বিভাব হয়ে।যৌবনে বিলাতফেরত রমানাথকে ঘিরে যে মোহজড়িত ভালোবাসা জাগল তার মনে সে কেবল ঐ গানের ই মোহ।গানের ই টানে মণি বাগদত্তা হল তার। উপন্যাসে গানের ব্যাবহারের এক অন্যরকম ভূমিকা আছে।উপন্যাসের ঘটনাস্রোতের সঙ্গে নায়ক নায়িকার মনোজগতের মিলিয়ে একটি মাত্র গানকে ই উপন্যাসের পরিনতির নিয়ামক সূত্র করেছেন ঔপন্যাসিক।উপন্যাসের কাহিনি পরিনতিমুখী হয় মণি যখন রমানাথের বিদেশীনী প্রেমিকার খবর শুনে বাগদানের বাঁধন ছিড়ে ফেলে।তারপর, মণি নতুন করে মন হারায় এক ডাক্তারের প্রেমে।এই ডাক্তার এর সংগে মণির বাবা বিয়ে ঠিক করেন।এই ডাক্তার ই হলেন সেই বাল্যকালের পড়ার সাথী ছোটু।যে বর্তমানে ডাক্তার বিনয় কুমার। কাহাকে ভালোবেসেছে মণি? এই সমাধান ই উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। ছোটু -বিনয় কুমার -ডাক্তার, -নতুন পুরাতন মিলেমিশে মণি যাকে বরন করে নিল, তাঁর কোন রূপ মন ভূলিয়েছে?অতীত না ভবিষ্যৎ। ছোটু না ডাক্তার? বাল্য ও যৌবনের এই দুই ভালোবাসার মূর্তির কাহাকে ভালোবাসতে গিয়ে কাহাকে ভালোবেসেছে সে? অস্বীকার করা যায় না, মণি দয়িত ডাক্তার বিনয় কুমারের মধ্যেই তার বাল্যসঙ্গী ছোটুকে আবিষ্কার করে তার মন জগতের জটিলতার জট কাটিয়েছে। সেই ইচ্ছাপূরণ এর সুরেই কাহিনি পূর্ণতা পেয়েছে।
স্বর্ণকুমারী দেবী (২৮ অগস্ট, ১৮৫৫ – ৩ জুলাই, ১৯৩২) ছিলেন একজন বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতকার ও সমাজ সংস্কারক।স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্রী এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ কন্যা। তাঁর তিন দিদির নাম ছিল সৌদামিনী, সুকুমারী ও শরৎকুমারী। তাঁর ছোটোবোনের নাম ছিল বর্ণকুমারী। সৌদামিনী ছিলেন বেথুন স্কুলের প্রথম যুগের ছাত্রী। ঠাকুর পরিবারের অন্যান্য মহিলা সদস্যেরা তাঁকে অনুসরণ করলেও, স্বর্ণকুমারী দেবী প্রধানত বাড়িতেই লেখাপড়া শিখেছিলেন। তিনি তাঁর অনুজ ভ্রাতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে পাঁচ বছরের বড়ো ছিলেন।১৮৬৮ সালে জানকীনাথ ঘোষালের সঙ্গে স্বর্ণকুমারী দেবীর বিবাহ হয়।সংগীত, নাটক ও সাহিত্যে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পুরুষ সদস্যদের সৃষ্টিশীলতা স্বর্ণকুমারী দেবীকেও স্পর্শ করেছিল। এই সময় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এই তিন ক্ষেত্রে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। তাঁকে সাহায্য করছিলেন অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী ও রবীন্দ্রনাথ। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন-স্মৃতি থেকে জানা যায়, জানকীনাথ ইংল্যান্ডে গেলে স্বর্ণকুমারী দেবী জোড়াসাঁকোয় এসে থাকতে শুরু করেছিলেন। এই সময় তিনিও তাঁদের সঙ্গে নতুন পরীক্ষানিরীক্ষায় মেতে ওঠেন। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী যখন পরিবারের প্রাচীন প্রথাগুলিকে নারী স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করছিলেন, ঠিক সেই সময় স্বর্ণকুমারী দেবী সাহিত্য সাধনায় মগ্ন ছিলেন।১৮৭৬ সালে স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রথম উপন্যাস দীপনির্বাণ প্রকাশিত হয়।স্বর্ণকুমারী দেবীর স্বামী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি নিজেও সামাজিক সংস্কার ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।সখীসমিতির প্রধান উদ্দেশ্য হল অসহায় অনাথ ও বিধবাদের সহায়তা করা। এই কাজ দু'ভাবে করা হবে। যেক্ষেত্রে এই সব বিধবা ও অনাথদের কোনো নিকটাত্মীয় নেই বা থাকলেও তাঁদের ভরণপোষণের ক্ষমতা সেই আত্মীয়দের নেই, তাঁদের ভরণপোষণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব সখীসমিতি নেবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে সখীসমিতি তাঁদের যথাসাধ্য সাহায্য করবে। সখীসমিতি যে সব মেয়েদের পূর্ণ দায়িত্ব নেবে, তাঁদের লেখাপড়া শিখিয়ে স্ত্রীশিক্ষার প্রসার ঘটাবে। তাঁরা শিক্ষা সম্পূর্ণ করে অন্যান্য মহিলাদের লেখাপড়া শেখাবেন। সমিতি এই জন্য তাঁদের পারিশ্রমিকও দেবে। এইভাবে দু'টি উদ্দেশ্য সাধিত হবে। হিন্দু বিধবারা হিন্দুধর্মের অনুমোদনক্রমেই শ্রমদানের মাধ্যমে উপার্জনক্ষম হয়ে উঠবেন। তিনিই ছিলেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম উল্লেখযোগ্য মহিলা সাহিত্যিক।