ভূমিকা বাঙলাদেশে সূফীতত্ত্ব ও সূফী-সাধনা একটি স্থানিক রূপ লাভ করেছিল। বৈদান্তিক সর্বেশ্বরবাদ বা অদ্বৈততত্ত্ব ও যোগের প্রত্যক্ষ প্রভাবই এর মুখ্য কারণ। অবশ্য মধ্য এশিয়ার বৌদ্ধমত ও বৌদ্ধ ভিক্ষুর প্রভাবে সিরিয়া, ইরাক ও ইরানে গুরুবাদী, বৈরাগ্য-প্রবণ ও দেহচর্যায় উৎসুক কিছু সাধকের আবির্ভাব বারো শতকের আগেই সম্ভব হয়েছিল। ইরান ও বলখ অঞ্চলের ভাবপ্রবণ লোকমনে বৈদান্তিক সর্বেশ্বরবাদের প্রভাবও পরোক্ষ মানসক্ষেত্র রচনায় সহায়তা করেছিল বলে মনে করি । তাই ভারতে যে-সব সূফী সাধক প্রবেশ করেন, ভারতিক অধ্যাত্ম তত্ত্ব ও সাধনার প্রভাব এড়ানো তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাঁদের কাছে দীক্ষিত দেশী জনগণ ও পূর্ব-ঐতিহ্যসূত্রে প্রাপ্ত অদ্বৈতচেতনা ও যোগপ্রীতি ত্যাগ করতে পারেনি। বিশেষ করে বিলুপ্ত বৌদ্ধ সমাজের ‘যৌগিক-কায়-সাধন’ তত্ত্ব তখনো জনচিত্তে অম্লান ছিল। ফলে “সূফীমতের ইসলাম সহজেই এদেশের প্রচলিত যোগমার্গ ও অন্যান্য আধ্যাত্মিক সাধনমার্গের সঙ্গে একটা আপোষ করে নিতে সমর্থ হয়েছিল।” একই কারণে ও পরিবেশে পরবর্তীকালে সূফীবাদের সামঞ্জস্য হয়ে সহজিয়া ও বাউল সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়। ব্রাহ্মণ-শৈব ও বৌদ্ধ তান্ত্রিক সহজিয়ার সমবায়ে গড়ে উঠেছে একটি মিশ্রমত। এর আধুনিক নাম নাথপন্থ। ‘অমৃতকুণ্ড’ সম্ভবত এদেরই শাস্ত্র ও চর্যাগ্রন্থ। এটি গোরক্ষ-পন্থীর রচনা বলে অনুমিত হয়। বামাচার নয়— কায়াসাধন তথা দেহতাত্ত্বিক সাধনই এদের লক্ষ্য। ‘হঠ’ যোগের মাধ্যমেই এ সাধনা চলে। এক সময় এই নাথপন্থ ও সহজিয়া মতের প্রাদুর্ভাব ছিল বাঙলায়, চর্যাগীতি ও নাথসাহিত্য তার প্রমাণ। এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক পরে ইসলামে ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়। কিন্তু পুরোনো বিশ্বাস-সংস্কার ত্যাগ করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম আর বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা নিজেদের পুরোনো প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে, এরই ফলে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত বাউল মতের উদ্ভব। অন্যদিকে অদ্বৈতবাদ ও যোগ পদ্ধতিকে সূফীরা নিজেদের মতের অসমন্বিত অঙ্গ করে নিয়ে যোগতত্ত্বে গুরুত্ব আরোপ করতে থাকে। এর ফলে মুসলিম সমাজে ও সাহিত্যে যোগের ও যোগসাধনার ব্যাপক প্রভাব ও চর্চা লক্ষ্য করি।
বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার অনন্য ব্যক্তিত্ব এবং মধ্যযুগের সাহিত্য ও ইতিহাসের বিদগ্ধ পণ্ডিত ড. আহমদ শরীফ পঞ্চাশ দশক থেকে নিয়মিতভাবে প্ৰবন্ধ লেখা শুরু করেছিলেন এবং তা তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চলমান ছিল। ড. আহমদ শরীফ এমন একজন ব্যক্তিত্ব যাকে উপেক্ষা করা যায় তবে কোনো অবস্থাতেই তাঁর বিশাল কীর্তি অস্বীকার করা যায় না । নিজস্ব দর্শন চিন্তা ও বৈশিষ্ট্যের কারণে বোদ্ধা সমাজের কাছে তিনি ছিলেন বহুল আলোচিত, সমালোচিত ও বিতর্কিত এবং তাঁর মৃত্যুর পরেও এ ধারা বহমান। ভাববাদ মানবতাবাদ ও মার্কসবাদের যৌগিক ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরণে, বক্তব্য ও লেখনীতে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ও সমাজ সম্পর্কে পাহাড়সম গবেষণাকর্ম, সহস্রাধিক প্ৰবন্ধ তাকে কিংবদন্তী পণ্ডিত হিশেবে উভয় বঙ্গে ব্যাপকভাবে পরিচিতি দিয়েছে। জন্ম ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯২১; গ্রাম সুচক্রদণ্ডী, উপজেলা পটিয়া, জেলা চট্টগ্রাম। পিতা আব্দুল আজিজ, মাতা সিরাজ খাতুন। প্রথম স্কুল চট্টগ্রাম শহরের আলকরণ মিউনিসিপ্যাল প্ৰাথমিক বিদ্যালয়। প্রবেশিকা পাশ করেন পটিয়া হাই স্কুল থেকে, আর আইএ, এবং বিএ পাশ করেন চট্টগ্রাম কলেজ থেকে, এবং এমএ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে । ১৯৬৭ সালে ডক্টরেট উপাধি লাভ, বিষয়: সৈয়দ সুলতান, তার যুগ ও গ্রন্থাবলী । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক । মৃত্যু ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ ৷৷