ভূমিকা বর্তমান গ্রন্থটি হচ্ছে আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে প্রকাশিত ফ্রয়েডের আদি ও মূল গ্রন্থ The Interpretation of Dreams-এর বঙ্গানুবাদ। শুধু একশো বছর আগেই নয়, সঠিকভাবে বলতে গেলে ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে অর্থাৎ ১৯০০ সালে এই গ্রন্থের প্রথম আবির্ভাব। তারপর দু-দুটি মহাযুদ্ধ ঘটে গেছে। সভ্যতার অগ্রগমনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনোবিকারও যে তদনুপাতে গভীর থেকে গভীরতর হতে পারে লাগামছাড়া অবিরাম অগ্রগতির অনিবার্য মূল্য হিশেবে—এমন বিপদের ইংগিত আমরা ফ্রয়েডীয় ভাবনার মধ্যে সম্ভবত পাই। মনোরোগ বা মনোবিকারের উৎস খুঁজতে গিয়ে ফ্রয়েড পৌঁছেছিলেন স্নায়ুরোগী বা মনোরোগীদের স্বপ্ন-বিশ্লেষণে। স্বপ্ন-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নিজ্ঞান (unconscious) মনের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন ফ্রয়েড। এটি তাঁর যুগান্তকারী আবিষ্কার। মন বলতে সাধারণত আমরা বুঝি সচেতন (conscious) মন, কিন্তু ফ্রয়েড দেখালেন, মনের খুব সামান্য অংশই জুড়ে থাকে সচেতন মন, বাদবাকী বিশাল অংশ জুড়ে, নিজ্ঞান। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এখানেই আমাদের অবৈধ আদিম কামনাগুলি অবদমিত হয়ে জমতে থাকে, অবৈধ আদিম কামনা বলতে শুধু নিষিদ্ধ যৌন কামনা নয়, অবৈধ ক্ষমতা লোভ, অবৈধ পররাজ্য গ্রাস, ঔপনিবেশিক জমি দখলের লোভ, পাইকারী লুণ্ঠন, হত্যা, দাস ব্যবসায়, অবৈধ রক্ত লিপ্সা, ধর্ষকাম, এসব কিছুই বোঝায়। শুধু মানবজাতির প্রাগৈতিহাসিক আদিম হিংস্রতা নয়, প্রাণের বিবর্তনে আদিম জলজীবন উদ্ভিদজীবন, পশুজীবনের নিজ্ঞান অভিজ্ঞতার বহু স্মৃতি মানব মনে যে-দুর্মর ছাপ রেখে গেছে, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে স্বপ্নে। ঐ প্রাচীন স্মৃতিকে ফ্রয়েড বলেছেন, phylogenetic memory বা প্রজাতিজনিত স্মৃতি। এই সমস্ত স্মৃতি এবং অবদমিত অবৈধ কামনারাশি কোনো কোনো সময় পুঞ্জিভূত বঞ্চনা ও অতৃপ্তির তীব্র চাপে যেমন ব্যক্তিজীবনে, তেমনি সমাজ জীবনেও একদিন হঠাৎ-ই ভীষণ ভয়াল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেয়। ব্যক্তিজীবনে তা মনোরোগ বা স্নায়ুরোগ, সমাজ জীবনে, তা মহাযুদ্ধ, পররাজ্য আক্রমণ, একনায়কত্ব, সন্ত্রাসবাদ, গণহত্যা,—এসবেরই চেহারা নিয়ে এসে হাজির হয় । মনোরোগের বহিঃপ্রকাশ যেমন ঘটে তার উপসর্গে, তেমনি মানুষের অবৈধ কামনার আত্মপ্রকাশ ঘটে স্বপ্নে। ফ্রয়েড যে কেবল মনোরোগী বা স্নায়ুরোগীদের স্বপ্ন-বিশ্লেষণ করেছেন তাই নয়, তিনি নিজের স্বপ্নেরও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন এই গ্রন্থে। বিজ্ঞানীর মর্মভেদী সততার সঙ্গে নিজের স্বপ্নের ভেতর অনুসন্ধান চালিয়ে ফ্রয়েড নিজেরই অবৈধ কামনাকে হাজির করেছেন পাঠকের সামনে ।
সিগমুন্ড ফ্রয়েড ১৮৫৬ সালের ৬ মে ফ্রেইবার্গের মােরাভিয়া শহরে জন্মগ্রহণ করেন। অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন শেষে ১৮৮১ সালে ডক্টর অব মেডিসিন ডিগ্রি লাভ করেন। এর পর থেকেই ফ্রয়েড মস্তিষ্কের শরীর সংস্থান, স্নায়ু রােগসহ মানসিক ব্যাধি নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। এবং পরিণতিতে মনােবিশ্লেষণ নামে এক নতুন জ্ঞানকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটান, যার প্রভাব অদ্যাবধি মানববিদ্যার সকল শাখায় অবিসংবাদিত। দীর্ঘ কর্মময় জীবনে তিনি অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেছেন। ১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর লন্ডনে তাঁর জীবনাবসান ঘটে।