‘একদিন হঠাৎ তৌফিকের একটি বিশেষ ইচ্ছে হলো। কোনো এক প্রবল বর্ষণের দিনে নাদিয়াকে নিয়ে খালি পায়ে বৃষ্টিতে হাঁটতে চায় সে। তৌফিকের প্রস্তাব শুনে নাদিয়ার ভেতর কেমন যেন একটা ঘোর তৈরি হলো। একটা ব্যস্ত রাজপথ। বৃষ্টি পড়ছে অবিরাম। খালি পায়ে নির্জন ফুটপাত ধরে পাশাপাশি হাঁটছে ওরা। ওদের পোশাক ভিজে যাচ্ছে, শরীর ভিজে যাচ্ছে সমস্ত নগরী। ভাবতেই ভালো লাগে। নাদিয়ার বয়সটাও ছিল তখন বৃষ্টিতে ভেজার।’ ইমন চৌধুরীর উপন্যাস ‘রোদ পড়েছে ডানার’ একটি দৃশ্য। দৃশ্যই বলা চলে। কেননা ইমন চৌধুরীর লেখনীর দক্ষতা এমনই যে, শব্দ আর বাক্যের মধ্য দিয়ে চরিত্রগুলো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। চরিত্রগুলো আমাদের চোখের সামনে চলাফেরা করে। ফলে আমরা তার উপন্যাস পড়তে গিয়ে যেন কোন জীবনের পাঠ নেই। যেন জানালার পাশে বসে মুগ্ধ নয়নে পথের মানুষের যাতায়াত দেখি। নানা রঙ, নানা আকৃতি, নানা গল্প বুনি তাদের এক একজনকে নিয়ে। প্রথমেই এ উপন্যাসটির নাম যে কাউকে আকর্ষণ করবে। কাব্যিক ও ব্যঞ্জনাময় এ নামের আড়ালে কিংবা এ নামের ইশারায় মানব জীবনের একটি নান্দনিক বিমূর্ত রূপ রয়েছে। মানুষের অস্থি মজ্জা শরীরের বাইরেও এক দার্শনিক উপলদ্ধিবোধ আছে, আছে নিজস্ব আবেগ, অনুভূতি আর স্বপ্ন কল্পনার বৈভব। কখনও বাস্তবতা ও কখনও কল্পনার যৌথ যাপনে মানুষ পায় বেঁচে থাকার প্রেরণা। প্রেম, ভালোবাসা এ উপন্যাসের একটি অনুসঙ্গ কিন্তু প্রধান নয়। মানবিকতা, মহত্ব কিংবা ত্যাগের যে মহিমা তার দিকে পাঠকদের নিয়ে চলেন ইমন চৌধুরী তার উপন্যাসের নেতৃত্বে। শহুরে জীবনের জটিলতা, পারিবারিক ও ব্যক্তিত্বের যে ভারসম্যতা তা যেন কখনও হেলে পড়ে আবার কখনও পতন ঘটে। সৌরভ, নাদিয়া, আনিসুর রহমানসহ আরো অনেক চরিত্র তাদের গল্প, তাদের চাওয়া পাওয়ার হিসাব নিয়ে পাঠকের জন্য অপেক্ষা করছে এ উপন্যাসের পাতায় পাতায়। গাছে ফুটে থাকা ফুল না ছিড়লেও এর ঘ্রাণ সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায় দূর থেকে। মিলন কিংবা বিরহ নয়, জীবনের প্রবহমানতাই এ উপন্যাসের অনুকূলে।
শূন্য দশকের একজন উল্লেখযোগ্য লেখক ইমন চৌধুরী। এ সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক। জন্ম ১৮ জুন। নোয়াখালীর মাইজদী সরকারি কলোনিতে। পিতা মফিজুর রহমান চৌধুরী’র সরকারি চাকরির সুবাদে শৈশবের একটি উল্লেখযোগ্য সময় কেটেছে এখানে। মা দেলোয়ারা বেগম গৃহিনী। পৈতৃক বাড়ি ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার পৈথারা গ্রামে। ফেনী সরকারি পাইলট হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ফেনী সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। প্রথম আলো পত্রিকার এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় সাপ্তাহিক রম্য ও বিদ্রুপ ম্যাগাজিন ‘আলপিন’-এর মাধ্যমে প্রথম হাজির হয়েছিলেন পাঠকের সামনে। এরপর ইত্তেফাক, সমকাল, যুগান্তর, কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ শীর্ষস্থানীয় প্রায় সব সংবাদপত্রেই নিয়মিত লিখেছেন। লিখছেন এখনও। সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে রম্য ও বিদ্রুপ লিখে জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও ইমন চৌধুরী জীবনঘনিষ্ঠ গল্প-উপন্যাস লিখতেই বিশেষ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। প্রথম প্রকাশিত বই ‘লাল পাড় সাদা শাড়ি’। প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘মেঘের কাছে রোদের কাছে’। উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে ‘পাশের মানুষ’, ‘পায়ে তার কাচের নূপুর’, ‘এই বসন্তে এসো’, ‘রোদ পড়েছে ডানায়’, ‘ডেকে যায় ফাল্গুনের রোদ’, ‘অন্তহীন’ অন্যতম। লেখালেখির সূত্রেই পেশাগত জীবনে বেছে নিয়েছেন সাংবাদিকতা। বর্তমানে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় জৈষ্ঠ সহ-সম্পাদক পদে কর্মরত আছেন। জীবন নিয়ে বিশেষ কোনো পরিকল্পনা নেই। রোগ, শোক, মহামারী, অনিশ্চয়তার এই মানব জীবনে মহাকালের কাছে কিছু গল্প জমা রেখে যেতে চান কেবল।