"গল্প সমগ্র" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: বাংলা সাহিত্যে কমলকুমার মজুমদার একাই এক প্রতিষ্ঠান। স্বতন্ত্র ও স্বমহিম, অনন্য ও অভিজাত। কল্লোল কালিকলম, বা পরিচয় পত্রিকা থেকে উদ্ভূত লেখককুলেরই সমসাময়িক কমলকুমার। কিন্তু তাঁকে কোনও একটি বিশেষ পত্রিকা দিয়ে চিহ্নিত করা যাবে না। কমলকুমারকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে লেখকগােষ্ঠী, অথচ তিনি কোনও গােষ্ঠীর লেখক নন। প্রথম থেকেই কমলকুমার মজুমদার চরিত্র্যে ও লেখকসত্তায় আলাদা। দেশ-চতুরঙ্গ-পরিচয় ইত্যাদি নামী পত্রিকায় তাঁর গল্প ছাপা হয়েছে বটে, কিন্তু কমলকুমারের সব-ছাপানাে পরিচয়, তিনি লিটল ম্যাগাজিনের লেখক। এমন-কি, খ্যাতিপরিকীর্ণ পরিণত বয়সেও লিটল ম্যাগাজিনের ছােট আধারে এমন বড় মাপের লেখক আর পাওয়া গিয়েছে কিনা সন্দেহ। সাহিত্যের ইতিহাসে বিষয়ের পাশাপাশি স্টাইলও যে সমান গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক, একথা সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করতেন কমলকুমার মজুমদার। আজীবন তাই স্টাইল নিয়ে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেছেন। চলতি বাংলা দিয়ে শুরু করেও কমলকুমার ক্রমশ ঝুঁকেছিলেন সাধু বাংলার গদ্যরচনার দিকে। শেষাবধি নির্মাণ করেছিলেন নিজস্বতাস্পন্দিত এমন-এক ভাষারীতি, যা অনায়াসে চিনিয়ে দেয় কমলকুমারকে। খুব কম লেখকই, বলা বাহুল্য, এই সার্থকতা অর্জন করতে পারেন। গৃঢ় ও গভীর, কবিত্বময় অথচ ঋজু কমলকুমারের বাংলা রবীন্দ্রনাথ কি শরৎচন্দ্রের বাংলার থেকে একেবারে ভিন্নস্বাদ। দৃষ্টিভঙ্গি আন্তর্জাতিক, কিন্তু কমলকুমারের গল্প-উপন্যাসে দেশের মানুষের কথাই ফিরে-ফিরে এসেছে। মাটির গন্ধমাখানাে এই সব লেখার মধ্যে, বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করতে হয়, দীনদরিদ্র চরিত্রগুলিকে কী সম্মানের সঙ্গে ব্যবহার করেছেন কমলকুমার। এদের নিয়ে চেনা ছকের প্রথাসিদ্ধ সহানুভূতিপূর্ণ গল্প কখনও লেখেননি তিনি, মানুষের পূর্ণ মর্যাদায় জীবন্ত রূপে এঁদের চিত্রিত করেছেন। মতিলাল পাদরি’ বা ‘কয়েদখানা', ‘তাহাদের কথা’ বা ‘নিম অন্নপূণটির মতাে গল্প যে-কোনও ভাষার স্থায়ী সম্পদ । কমলকুমারের বেশকিছু গল্প নিয়ে একদা প্রকাশিত হয়েছিল, ‘গল্প-সংগ্রহ'। অধুনাদুস্পাপ্য সেই গল্প সংগ্রহের সঙ্গে কমলকুমার-রচিত অবশিষ্ট প্রতিটি গল্প যােগ করে আনন্দ-সংস্করণে প্রকাশিত হল কমলকুমার মজুমদারের যাবতীয় গল্পের অখণ্ড ও অসামান্য এই সংকলন, ‘গল্প-সমগ্র'।
কমলকুমার মজুমদার (জন্ম : ১৭ নভেম্বর, ১৯১৪ - মৃত্যু : ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৯) বিংশ শতাব্দীর একজন বাঙালি ঔপন্যাসিক যিনি আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে পরিগণিত। তাকে বলা হয় 'লেখকদের লেখক'। তার উপন্যাস অন্তর্জলী যাত্রা এর অনন্যপূর্ব আখ্যানভাগ ও ভাষাশৈলীর জন্য প্রসিদ্ধ। বাংলা কথাসাহিত্য বিশেষ করে উপন্যাস ইয়োরোপীয় উপন্যাসের আদলে গড়ে উঠেছে, কমলকুমার মজুমদার সেই অনুসরণতা পরিহার করেছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের দুরূহতম লেখকদের একজন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বিখ্যাত ছিলেন; যেমন সুহাসিনীর পমেটম উপন্যাসে ২৫০ পৃষ্ঠায় যতি-চিহ্ন বিহীন মাত্র একটি বাক্য লক্ষ্য করা যায়। তিনি বাংলা সাহিত্যের দুর্বোধ্যতম লেখক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। দীক্ষিত পাঠকের কাছে কমলকুমার অবশ্যপাঠ্য লেখক হিসেবেই সমাদৃত হলেও অদ্যাবধি তিনি সাধারণ্যে পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেন নি।