"ব্যবহারিক বাংলা বিপরীত শব্দের অভিধান" বইটির ভুমিকা থেকে নেয়াঃ ‘ব্যবহারিক বাংলা বিপরীত শব্দের অভিধান' বাংলা ভাষা চর্চা ও প্রসারে আগ্রহীদের প্রয়ােজনের কথা স্মরণ করে সংকলন করা হয়েছে। শব্দ হলাে পরম ব্রহ্মের মতাে, যার কোনাে বিকল্প হয় না। যেমন : ‘বালার্ক’ ও ‘মার্তণ্ড’ দুটোই সূর্যের সমার্থক শব্দ হিসেবে স্বীকৃত; কিন্তু সার্বিক বিচারে এ দুটো পূর্ণ সমার্থক নয়। বালার্ক হলাে ভােরবেলার সূর্য আর ‘মার্তণ্ড হলাে মধ্যাহ্নের খরতাপবর্ষী সূর্য। কেউ যদি লেখেন, দিবসের সূচনাতে মার্তণ্ডের আলােয় আমার ঘুম ভেঙে গেল-বাক্যটি যথার্থ হবে না। কারণ দিবসের সূচনাতে ‘মার্তণ্ড' পাবার কোনাে সুযােগ নেই। এখানে ‘মার্তণ্ড’-এর বদলে ‘বালার্ক লিখতে হবে। অতএব, সূর্যের সমার্থক শব্দ হিসেবে গৃহীত হলেও ‘বালার্ক’ ও ‘মার্তণ্ড’ পৃথক, অনন্য ও নিজস্ব গুণধারী শব্দ। তেমনি সবিতা, রবি, দিবাকর ইত্যাদি শব্দও আপন আপন অর্থ ও বিভূতি ধারণকারী। তাই বলা হয়, শব্দ পরম ব্রহ্মের মতাে-এর তুলনা সে নিজেই। বাংলায় যতাে শব্দ আছে প্রতিটি শব্দই এক একটি পৃথক ‘ইমেজ ধারণ করে। ভাষাকে ভালােভাবে জানতে হলে এই ইমেজধারী শব্দগুলাে গভীরভাবে আত্মস্থ করা জরুরি। শব্দের সমার্থক প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিপরীতার্থক প্রকাশের ধারণাও বর্তমান। কিন্তু এটাও সত্য বিপরীত শব্দগুলােও আসলে পৃথক ইমেজধারী। আমরা বিপরীত শব্দ ভাবার অবকাশ নিই না, এটাই বাস্তবতা। অধিকাংশ মানুষই ‘অ’ বা ‘না’ জুড়ে দিয়ে শব্দকে বিপরীত করতে চাই। যেমন : স্থাবরএর বিপরীত করতে চাই ‘অস্থাবর দিয়ে। কিন্তু যা অস্থাবর তার একটি শব্দ প্রকাশ আছে এবং তা হলাে ‘জঙ্গম’-এই শব্দটি আমাদের জানা চাই। আবার ‘অদূর’-এর বিপরীত শব্দ কী? অনেকে বলবেন, ‘দূর'। আসলে তা নয়। দূর’ হলাে মূল শব্দ। ‘অ’ দিয়ে কম দূরত্ব বােঝানাে হয়েছে। তাই ‘সু' দিয়ে অধিক দূরত্ব বােঝাতে হবে। অদূরের বিপরীত শব্দ হবে সুদূর। আর এক ধরনের বিপরীত শব্দের দিকে লক্ষ রাখতে হবে। যেমন, ‘গুপ্ত’ শব্দের বিপরীত শব্দ হলাে ‘প্রকাশ্য। কিন্তু ‘গুপ্তচর’ যদি মূলশব্দ হয় তবে এর বিপরীত শব্দ হবে ‘সহচর'। এটি একটি ধারণাগত বিপরীত শব্দ। এখানে প্রকাশ্যচর’ হবে না। আবার ‘গুপ্তহত্যার বিপরীত শব্দ প্রকাশ্যহত্যা’ও হবে না, ‘সহহত্যা’ও হবে ; হবে ‘গণহত্যা'। এভাবে বিপরীত শব্দগুলাে আত্মস্থ করা প্রয়ােজন। একটি কথা আছে : তিনি সেই ভাষা ভালাে জানেন, যিনি ঐ ভাষার বেশি বেশি সমার্থক ও বিপরীতার্থক শব্দ জানেন। কথাটি মিথ্যে নয়। আজ বাঙালির হাতে একটি কঠিন দায়িত্ব এসেছে যে, তার ভাষাকে সর্বত্র বিস্তার করার। প্রায় আটাশ কোটি বাঙালির মাতৃভাষা বাংলা এখন পৃথিবীর চতুর্থ মৌখিক ভাষা। দাপ্তরিক ভাষা হিসেবেও পৃথিবীতে বাংলার স্থান দশম। বহির্বিশ্বের অনেকেই বাংলা ভাষা শেখায় আগ্রহী হয়ে উঠছেন। তাঁদের আগ্রহ আরাে বেশি। ভাষাশেখার এক পর্যায়ে তাঁরা মূলশব্দের সমার্থক ও বিপরীতার্থক শব্দ সন্ধানে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। আসলে বাংলার সর্ববিস্তারী ক্রমাগ্রসরতা আমাদের সবারই আরাধ্য বিষয়। এই পরিপ্রেক্ষিত স্মরণে রেখেই বর্তমান গ্রন্থ প্রস্তুত করা হয়েছে। সবার কাজে লাগলেই আমরা আনন্দিত হবাে।
Dr. Soumittro Shekhor ড. সৌমিত্র শেখর কলামিষ্ট, প্রাবন্ধিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। বাংলায় স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণী প্ৰাপ্ত ড. শেখর সরকারি বৃত্তিপ্রাপ্ত গবেষক হিসেবে অত্যন্ত তরুণ বয়সে পিএইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেছেন (১৯৯৭), রবীন্দ্ৰভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, বিদ্যাসাগর-অধ্যাপক ড. ক্ষেত্র গুপ্তের তত্ত্বাবধানে। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও তিনি ১৯৯৬ সালে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে, প্রভাষক পদে। পরের বছর, পিএইচ. ডি. ডিগ্রি অর্জন হলে প্রভাষক পদে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে । কিশোর বয়স থেকে পত্রিকায় লেখালেখি শুরু হলেও নিয়মিত কলাম লেখা আরম্ভ করেন ১৯৯৭ সাল থেকে। বিক্ষুব্ধ সমকালকে তিনি ধারণ করেন কলামে, নিজস্ব চিন্তা দিয়ে চেষ্টা করেন তিমির হননে। রাষ্ট্ৰীয় বা উগ্ৰপন্থীদের ভ্ৰকুটি উপেক্ষা করেই লেখনী ধারণ করেন তিনি। সাহিত্য-আলোচনায় তিনি প্রয়োগ করেন একান্ত নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। ব্যক্তির মন-জোগান লেখায় বিশ্বাস নেই তাঁর। গতানুগতিক আলোচনায় দীর্ঘ দীর্ঘ শব্দের যত্রতত্র যে ব্যবহার, সেগুলো তার সাহিত্যালোচনায় একেবারেই দেখা যায় না। ড. শেখর বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলা একাডেমী, বাংলাদেশ ভাষা-সমিতির জীবন সদস্য। গবেষণার জন্য তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিনস এওয়ার্ড (২০০১) ও ময়েনউদ্দিন ফাউন্ডেশন পদক (২০০৮) লাভ করেন।