"মার্কস পাঠের ভূমিকা"বইটির প্রসঙ্গে কিছু কথা: কার্ল মার্কসের চিন্তারপ্রভাব ফরহাদ মজহার-এর যাবতীয় লেখালেখির মধ্যেই কমবেশি দেখা মিলে। কিন্তু এখানে একসাথ করা লেখাগুলার বিষয় সরাসরি কার্ল মার্কস। আরাে নির্দিষ্ট করে বললে, মার্কসের চিন্তার দিগন্ত যে সকল মৌলিক ধারণা আশ্রয় করে বিস্তৃত হয়েছে তার কয়েকটির সাথে পরিচয় ঘটানাে। মার্কসের হাতে অর্থশাস্ত্রীয় বিশ্লেষণের পদ্ধতি ও প্রকরণ যে বাঁক নিয়েছে তার মৌলিকতু কোথায় এবং কিভাবে মার্কস ধ্রুপদী অর্থনীতির ভ্রান্ত অনুমানগুলাে মােকবিলা করেছেন সেটা স্পষ্ট করে দেখানাে। কিম্বা মার্কসের নামে চালু বদ্ধমূল ধারণা কাটিয়ে সরাসরি মার্কসের নিজের রচনা পাঠে উদ্বুদ্ধ করা। এ সংকলনে একত্রিত লেখাগুলার বয়স দুই যুগ পার হয়েছে। সে হিসাবে অনেক পুরানা লেখা। কিন্তু বিষয় যখন মার্কসের চিন্তার নিবিষ্ট পাঠ এবং মার্কস বােঝাপড়ায় দীর্ঘদিন যাবৎ তৈরি হওয়া অস্পষ্টতা কাটানাের পথ পরিষ্কার করা, তখন বলা যায় বাংলাদেশে এর প্রাসঙ্গিকতা এখনও ফুরায়নি। সময় বদলালেও যে প্রয়ােজনে এই লেখাগুলা রচিত সে অভিষ্ঠ এখনাে অনেকটা অধরা। এ বাবদ পাঠকদের একটা ধারণা দেওয়া দরকার। সময়টা উনিশ বিরাশি। হুসেন মােহাম্মদ এরশাদ সামরিক শাসন জারি করেছেন। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্ররা সবার আগে প্রতিবাদে নেমে পড়ল। ছাত্র সংগঠনের অগ্রগামী এবং উদ্যোগী ভূমিকা প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকেই শুরুতে বাধা পায়। সামরিক সরকার বিরােধী আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা নিজেরাই অগ্রগামী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এই উদ্যোগে সামনের সারিতে থাকা একটা সংগঠন ছিল ছাত্র ঐক্য ফোরাম’। আর ছাত্র ঐক্য ফোরামের জন্ম হয় তৎকালে ছাত্রদের একটা রাজনৈতিক পাঠচক্র থেকে। স্বৈরাচার বিরােধী আন্দোলনের রাজনৈতিক কর্মসূচি নির্ধারণ ও পরিচালনার প্রয়ােজনে তখন দশ দফা রচিত হয়। এই প্রশ্নে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিশাবে ছাত্র ঐক্য ফোরাম তখন আন্দোলনের অভিমুখ নিছক সরকার পরিবর্তন বা নির্বাচনে সীমাবদ্ধ না করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উত্থান প্রসঙ্গের দিকে নিয়ে যাবার অবস্থান তুলে ধরে। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর বা গণতান্ত্রিক বিপ্লবের রাজনৈতিক কর্মসূচি বনাম বিদ্যমান রাষ্ট্রের অধীনে নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তর -- এই দুই অবস্থানের মধ্যে পার্থক্য ঘিরে যে শ্ৰেণী সমাবেশ ও মেরুকরণ দাঁনা বাধতে থাকে তাতে দেখা যায় প্রচলিত বামপন্থী বা বিপ্লবী ধারার দলগুলােও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের মৌলিক প্রশ্নগুলা পাশকাটিয়ে পুরানা রাষ্ট্রকাঠামাে ও সংবিধানকে বহাল রেখে নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্ত ন্তিরের কর্মসূচিকে প্রধান করে তােলে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রশ্নে বিপ্লবী রাজনৈতিক দলের কর্তব্য এবং কর্মসূচি নির্ধারণের প্রশ্নে তৎকালে প্রচলিত ভাবধারার সাথে ছাত্র ঐক্য ফোরামের অবস্থানের পার্থক্যের মূল নিহিত মার্কসের চিন্তা, বিশেষত শ্ৰেণী, সম্পত্তি, উৎপাদন এবং উৎপাদন সম্পর্ক ইত্যাদি মৌলিক ধারণাগুলাে সম্পর্কে বােঝাপড়ায়। ফলত, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও কর্তব্যকর্ম নিরূপনে নীতি ও কৌশলগত অবস্থানেও তৈরি হয় ভিন্নতা। প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক লড়াইয়ের ময়দান থেকে উঠে আসা এইসব প্রশ্নের উত্তর মার্কসের পর্যালােচনা এবং বােঝাপড়ায় কি করে মীমাংসার করতে হবে তা নিয়ে ফোরামের কর্মীদের পাঠচক্রের আলােচনার খসড়া আকারে প্রথম এই লেখাগুলা তৈরি হয়। পরে তা ছােট ছােট পুস্তিকা আকারে বিতরণের জন্য বের করা হয়েছিল। ইতােমধ্যেই ফরহাদ মজহার মার্কসের অর্থশাস্ত্র পর্যালােচনার ভূমিকা নামে লেখাটি অনুবাদ শেষ করেন। সেই লেখাটিও এই সংকলনভূক্ত করা হয়েছে। অনেক দিন পরে আমাদের বন্ধুরা মিলে আবার যখন দুই হাজার তিনচার সালের দিকে চিন্তা পাঠচক্রে মার্কস পড়ছিলাম তখন এই লেখাগুলাে আমাদের হাতে আসে। অনেকেই তখন এই লেখাগুলােকে একত্রিত একটা সংকলনভূক্ত পুস্তক আকারে সহজলভ্য করতে বলেন। যাতে করে বিভিন্ন পাঠচক্র ও আগ্রহী তরুণদের জন্য তা কাজে লাগতে পারে। একটা সময় সেই উদ্যোগ নেয়ার পর মনে হয়েছিল অনেক বিষয়েই আরাে বর্ধিত ও বিস্তারিত আলােচনা সংযুক্ত করার দরকার। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি। যারা চাইছিলেন এরমধ্যে তাদের তাগাদাও থামেনি। তাই এখন অনেকের বারংবার তাড়া ও প্রয়ােজনের কথা বিবেচনায় অবশেষে নতুন কোন পরিমার্জনা ছাড়াই ছেড়ে দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর ও জনগণের সংবিধান প্রণয়ণের যে প্রশ্নকে পাশকাটিয়ে নব্বইয়ে তথাকথিত গণঅভূত্থানের তৃপ্তি সবাই নিতে চেয়েছিল তা আজ এত তিক্ত এবং রিক্ত হয়ে উঠেছে যা আর কাউকে বলে দিতে হবে না। এই অনিবার্য বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের তরুণরা পুরানাে ভুল থেকে শিখতে এবং এখনকার প্রয়ােজনীয় ভূমিকা পালনে সঠিক প্রশ্নটি ধরে এগিয়ে যেতে এই সংকলন কিছুটা হলেও সহায়ক হবে।
জন্ম ১৯৪৭ সালে, নোয়াখালী। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা : ঔষধশাস্ত্র ও অর্থনীতি, প্রিয় স্মৃতি : মাইজদী কোর্ট, প্রিয় স্থান : বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা নয়াকৃষির বিদ্যগাঘর। তিনি একজন বাংলাদেশি কবি, কলামিস্ট, লেখক, ঔষধশাস্ত্রবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বুদ্ধিজীবী, সামাজিক ও মানবাধিকার কর্মী এবং পরিবেশবাদী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে ওষুধশাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের দি নিউ স্কুল ফর সোশাল রিসার্চ থেকে অর্থশাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সামাজিক অর্থনীতিতেও গবেষণা করেছেন। চিন্তা নামক একটি পত্রিকার সম্পাদক মজহার উবিনীগ এনজিও গঠন করে নয়াকৃষি আন্দোলনও শুরু করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ হল: প্রস্তাব, মোকাবিলা, এবাদতনামা ও মার্কস পাঠের ভূমিকা।