ভূমিকা পুরাণ-অনুষঙ্গকে সাহিত্যে নিজের মতো করে রূপদানের প্রয়াস কবিরা সব যুগেই করেছেন। মঙ্গলকাব্য এবং শিবায়ন এ ব্যাপারে বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। দেবী চণ্ডিকা, শিব ও অন্নপূর্ণা, সূর্যদেবের লোকায়ত রূপ ধর্মঠাকুর—এই পৌরাণিক দেব-দেবীদের নিয়ে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে চমৎকার নতুন কাব্য লেখা হয়েছে। উনিশ শতকেও এই ধারা লুপ্ত হওয়ার পরিবর্তে পল্লবিত হয়ে উঠেছে মধুসূদন, হেমচন্দ্ৰ নবীনচন্দ্রের আখ্যানকাব্যে, রবীন্দ্রনাথ রচিত কোনও কোনও কবিতায় এবং বহুল পরিমাণে বাংলা নাটকে। কাজেই পুরাণ-অনুষঙ্গের পুনঃপ্রয়োগ বাংলা সাহিত্যে কোনও নতুন কথা নয়। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে এই পুরাণ-প্রয়োগের দৃষ্টিকোণ এবং চিন্তনশৈলী কিছু আলাদা হয়ে গেছে । প্রথমত মধ্যযুগে পুরাণ-অনুষঙ্গবাহী কাব্যগুলিতে কবিচিত্তের ধর্মবিশ্বাস এবং দেব-দেবীতে আস্থা ছিল অক্ষুণ্ণ। যদিও ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল কাব্য' (১৭৫২) সম্পর্কে বলা হয় যে কাব্যটি ভক্তিবাদের লক্ষণকে ধারণ করে না। সেকথা আংশিক সত্য। কিন্তু প্রত্যক্ষত দেব-মহিমাকে অস্বীকার করেননি ভারতচন্দ্র। উনিশ শতকেও এই ভক্তিবাদী মানসিকতার কিছুটা রেশ থেকে গেছে। মধুসূদনের ভাবনায় রাম ও সীতার চরিত্র তাঁদের পৌরাণিক মহিমা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত হয়নি। বেশ কিছু নাটকে পৌরাণিক চরিত্রগুলিকে প্রথাসিদ্ধ মহিমাব্যঞ্জিত করে প্রকাশ করা হয়েছে। অর্থাৎ ভক্তি না হোক বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধার একটি রেশ থেকে গেছে পুরাণ-নির্ভর সাহিত্যের ভাববস্তুর রূপায়ণে। কিন্তু বিংশ শতাব্দী এই ব্যাপারে উনিশ শতক এবং তার পূর্ববর্তী কালপর্ব থেকে আলাদা। এখানে ক্রিয়াশীল হয়েছে সমাজবাদী বিশ্লেষক মন। ভক্তিধৰ্ম সেখানে প্রায়শই অনুপস্থিত। কাজেই বিশ শতকের কবিদের পুরাণ-দৃষ্টি এবং পুরাণ-ভাবনা অনেক বেশি বিজ্ঞানসম্মত এবং সেখানে যেন পুরাণ এসেছে একালের ভাবনাকেই সাক্ষ্য প্রমাণে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য। উনিশ শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে এ ধরনের সুর ছিল না। তাই একথা বলা যায় যে, বিশ শতকীয় বাংলা কবিতায় পুরাণ অনেক বেশি একালের কবিদের বাস্তব ও লোকায়ত জীবনের কাছাকাছি এসেছে।