পদ্মানদীর মাঝি, রূপসী বাংলা, বনলতা সেন, শেষের কবিতা
‘পদ্মানদীর মাঝি’ বইয়ের কথাঃ কুবেরের ধমক খাইয়া গণেশ খানিকক্ষণ চুপ। করিয়া রহিল। তারপর নিজেই ধরিয়া দিল। গান । সে গাহিতে পারে না । কিন্তু তাহাতে কিছু আসিয়া যায় না। ধনঞ্জয় ও কুবের মন। দিয়া গানের কথাগুলি শােনে। যে যাহারে। ভালবাসে সে তাহারে পায় না কেন, গানে এই গভীর সমস্যার কথা আছে। বড় সহজ গান। নয়। পুবদিক লাল হইয়া উঠা পর্যন্ত তাহারা জাল ফেলিয়া বেড়াইল। তারপর রওনা হইল। জাহাজঘাটের দিকে। সেইখানে পৌছিতে পৌছিতে চারদিক আলাে হইয়া উঠিল । নদীর তীরে, নদীর জলে এখন জীবনের সাড়া পড়িয়া গিয়াছে। থাকিয়া থাকিয়া স্টিমারের। বাঁশি বাজিয়া উঠে। সশব্দে নােঙর তুলিয়া। কোনাে স্টিমার ছাড়িয়া যায়, কোনাে স্টিমার ভেড়ে গিয়া জেটিতে। কলিকাতা হইতে ট্রেনটি আসিয়া পড়িয়াছে। ঘাটের ও স্টেশনের। দোকানপাট সমস্ত খােলা হইয়াছে। অনেকে নদীর জলে স্নান করিতে নামিয়াছে। মােটরবাহী ও যাত্রীবাহী অসংখ্য ছােটবড় নৌকা ঘাটে ভিড় করিয়া আসিয়াছে । ঘাটের দিকে বহুদূর অবধি তীর ঘেঁষিয়া কাদায়-পোঁতা লগির সঙ্গে বাঁধা আরাে যে কত নৌকা তাহার সংখ্যা নাই।
রূপসী বাংলা' বইয়ের কথাঃ ঘুমায়ে পড়িব আমি জানি একদিন তােমাদের নক্ষত্রের রাতে শিয়রে বৈশাখ মেঘ—শাদা-শাদা যেন কড়ি-শঙ্খের পাহাড় নদীর ওপার থেকে চেয়ে র’বে—কোনাে এক শঙ্খবালিকার ধূসর রূপের কথা মনে হবে—এই আম জামের ছায়াতে। কবে যেন তারে আমি দেখিয়াছি—কবে যেন রাখিয়াছি হাতে তার হাত —কবে যেন তারপর শ্মশান চিতায় তার হাড়। ঝরে গেছে, কবে যেন; এ জনমে নয় যেন —এই পাড়াগাঁর পথে তবু তিন শাে বছর আগে হয়তাে বা—আমি তার সাথে কাটায়েছি; পাঁচ শাে বছর আগে হয়তাে বা সাত শশা বছর কেটে গেছে তারপর তােমাদের আম জাম কাঁঠালের দেশে; ধান কাটা হয়ে গেলে মাঠে মাঠে কতবার কুড়ালাম খড়, বাঁধিলাম ঘর এই শ্যামা আর খঞ্জনার দেশ ভালােবেসে, ভাসানের গান শুনে কতবার ঘর আর খড় গেল ভেসে।
‘বনলতা সেন’ বইয়ের অংশঃ কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালােবাসে! হায় চিল, সােনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে । তুমি আর উড়ে-উড়ে কেদো নাকো ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে।
শেষের কবিতা বইটির কিছু কথাঃ কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও তারি রথ নিত্যই উধাও জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন, চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষফাটা তারা ক্রন্দন। ওগাে বন্ধু। সেই ধাবমান কাল। জড়িয়ে ধরিল মােরে ফেলি তার জাল — তুলে নিল দ্রুতরথে। দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে তােমা হতে বহুদূরে। মনে হয়, অজস্র মৃত্যুরে পার হয়ে আসিলাম। আজি নবপ্রভাতের শিখরচূড়ায় – রথের চঞ্চল বেগ হাওয়া উড়ায়। আমার পুরাে নাম। ফিরিবার পথ নাহি; দূর হতে যদি দেখ চাহি পারিবে না চিনিতে আমায়। হে বন্ধু বিদায়।
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।