সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.-এক বিস্ময়কর প্রতিভা। ইতিহাসে এরূপ মহামনিষীর আগমনই ইসলামের শাশ্বত সৌন্দর্য ও গ্রহণযােগ্যতা বার বার পৃথিবীর কাছে তুলে ধরে। ইসলাম থেকে দূরে সরতে সরতে একসময় মানুষ। তার নিজের পরিচয়ই ভুলে যায়। দুনিয়ার ব্যস্ততা আর পরকাল বিমুখতা তাকে বেঘােরে দীর্ঘ আশার অতলে তলিয়ে ফেলে। সেই তলানি থেকে জাগিয়ে তােলার জন্য প্রয়ােজন হয় এক অনিরুদ্ধ কণ্ঠস্বর, এক জ্বালাময়ী ঈমানী চেতনার বলিষ্ঠ উচ্চারণ । এই চেতনার বাস্তব প্রতিমূর্তি ছিলেন সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.। তার সমুজ্জ্বল জীবন ও কর্মকাণ্ড গােটা পৃথিবীতে এক জাগরণ তৈরি করেছিল যা এখনাে একইভাবে ক্রিয়াশীল। আর এ পথে তার ভাষণগুলাে মানুষের হৃদয়ে যুগের পর যুগ ধরে ইসলামের আহ্বানে বেদিশার দিশা হয়ে আছে। মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা অবলােকন করে তারই কিছু আবেগ ও বেদনামিশ্রিত ভাষণ তােমাকে বলছি হে আরব গ্রন্থে বর্ণনা করা হয়েছে। গ্রন্থটি মূলত ইসমাঈয়্যাত এর অনুবাদকে কেন্দ্র করে রচিত হলেও এতে আরও কিছু ভাষণ বিভিন্ন কিতাব ও রেসালা থেকে সংযুক্ত করা হয়েছে। ফলে আরবে প্রদত্ত ভাষণের সঙ্গে এ উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রদত্ত ভাষণও রয়েছে। উনবিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি এসব ভাষণে ঐ সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে ইসলাম চর্চা ও বাস্তবতার নানা অসঙ্গতি তুলে ধরা হয়েছে। মুসলমানদের সার্বিক দুর্গতির কারণ চিহ্নিত করার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ কর্মপন্থাও বর্ণনা করা হয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সার্বিক পরিস্থিতির তেমন কোনাে উন্নতি হয়নি। বরং পুরাে বিশ্ব মুসলমানদের বিরুদ্ধে জোট বেধে ইসলাম ও মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার কাজে মেতে উঠেছে। ফলে গ্রন্থটি তার যুগের মানুষকে যেমন আলােড়িত করেছিল, এখনাে একইভাবে এসব বক্তব্য মুসলমানদের আশার আলাে হয়ে আছে। এটি স্বতঃসিদ্ধ যে, আরবেই ইসলামের সূচনা এবং এখনাে ইসলামের কেন্দ্রভূমি হয়ে আছে। তার পরামর্শ ও আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আরব বিশ্ব জেগে উঠলেই বিশ্বের মানচিত্রে ইসলামের পতাকা সমুন্নিত হবে। সেখান থেকেই পরিবর্তন সূচিত হওয়া প্রয়ােজন। একদিন হবেও। তখন মুসলিম জাতি ফিরে পাবে তাদের হারানাে ঐতিহ্য ও সম্মান।
আল্লাহর পথের এক মহান দাঈ,ইলমে ওহীর বাতিঘর যুগশ্রেষ্ঠ মনীষী। খাঁটি আরব রক্তের গর্বিত বাহক।বিশ্বময় হেদায়েতের রোশনি বিকিরণকারী।উম্মতের রাহবর ও মুরুব্বি। কল্যাণের পথে আহ্বানে চিরজাগ্রত কর্মবীর। জন্ম ১৯১৪ ঈসাব্দে। ভারতের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার সূতিকাগার উত্তর প্রদেশের রাজধানী লাখনৌর রায়বেরেলীতে। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া আদ্যোপান্তই দারুলউলুম নদওয়াতুল উলামায়। অধ্যাপনা জীবনের সিংহভাগও এই প্রতিষ্ঠানে নিবেদিত ছিলেন। আল্লামা নদভীর খ্যাতির সূচনা হয় বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকে "সীরাতে সাইয়েদ আহমদ শহীদ" রচনার মাধ্যমে।গ্রন্থটি গোটা ভারতবর্ষে তাকে পরিচিত করে তুলে।এরপর তিনি রচনা করেন 'মা যা খাসিরাল আলামু বিনহিতাতিল মুসলিমিন' (মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কী হারাল) নামক কালজয়ী গ্রন্থ।যা তাকে প্রথমত আরববিশ্বে ও পরবর্রতীতে বৈশ্বিক সুখ্যাতি এনে দেয়। এ পর্যন্ত গ্রন্থটির শতশত সংস্করণ বের হয়েছে। বিগত প্রায় পৌনে এক শতাব্দী ধরে তার কলম অবিশ্রান্তভাবে লিখেছে মুসলিম ইতিহাসের গৌরদীপ্ত অধ্যায়গুলোর ইতিবৃত্ত। সীরাত থেকে ইতিহাস, ইতিহাস থেকে দর্শন ও সাহিত্য পর্যন্ত সর্বত্রই তার অবাধ বিচরণ। উর্দু থেকে তার আরবী রচনায় যেন অধিকতর অনবদ্য। আল্লামা নদভী জীবনে যেমন পরিশ্রম করেছেন, তেমনি তার শ্বীকৃতিও পেয়েছেন। মুসলিম বিশ্বের নোবেল হিসেবে খ্যাত বাদশাহ ফয়সাল আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন।১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে দুবাইয়ে তিনি বর্ষসেরা আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্যক্তিত্ব নির্বাচিত হন।১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক সেন্টারের পক্ষ থেকে আলী নদভীকে সুলতান ব্রুনাই এ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। আন্তর্জাতিক বহু ইসলামী প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সদস্য ছিলেন। তিনি একাধারে রাবেতায়ে আলমে ইসলামী এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক সেন্টারের সভাপতি ছিলেন। লাখনৌর বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুলউলুম নাদওয়াতুল-উলামা' এর রেকটর ও ভারতীয় মুসলনমানদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরম মুসলিম পারসোন্যাল ল' বোর্ডের সভাপতি ছিলেন। ইসলামের এই মহান সংস্কারক ১৯৯৯ সনের ৩১ ডিসেম্বর জুমার আগে সুরা ইয়াসিন তেলাওয়াতরত অবস্থায় ইন্তিকাল করেন।