"বেশি দামে কেনা কম দামে বেচা আমাদের স্বাধীনতা" বইয়ের ভূমিকার অংশ থেকে নেয়া: ‘বেশি দামে কেনা কম দামে বেচা আমাদের স্বাধীনতা’ গ্রন্থে যে ৪২টি নিবন্ধ রহিয়াছে সেগুলির মধ্যে প্রথম ৩৯টি ১৯৭২ ও ৭৩ সালে দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক ইত্তেফাক’-এ প্রকাশিত হইয়াছে। আমার গুরু তখন অন্য কাগজে লিখিতেন। আমি সেই সময় ছিলাম ‘ইত্তেফাক’-এর সিনিয়র লিডার রাইটার ও কলামিস্ট (স্পষ্টভাষী)। আমিই তাঁহাকে ইত্তেফাক’-এ লিখিতে সম্মত করাই। গুরুশিষ্যের এমনি সম্পর্ক ছিল যে, শিষ্যের আবদার তিনি কখনও ফেলতে পারিতেন না। তিনি এতই উদার ছিলেন। এবং আমার উপর তাহার এতই বিশ্বাস ছিল যে, প্রয়ােজনবােধে তাঁহার লেখা সংশােধনের জেনারেল পাওয়ার-অব-এ্যাটর্নি তিনি আমাকে দিয়াছিলেন। অবশ্য সেই পাওয়ার আমার প্রয়ােগের কোন প্রশ্নই উঠে নাই, উঠিতে পারে না। এই গ্রন্থে প্রকাশিত ৪২-টি নিবন্ধ পাঁচ মিশালী হইলেও প্রত্যেকটির মূল বক্তব্য অভিন্ন। অর্থাৎ নানান দিকে উদ্ভূত জাতীয় সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানেরই পথ-নির্দেশনা তিনি লেখাগুলিতে দিয়াছেন। অনেক বিষয়ে তিনি লেখা ও আলােচনা শুরু করিয়া উহাকে আগাইয়া যাইবার দায়িত্ব ন্যস্ত করিয়াছেন আমার ন্যায় অযােগ্য শিষ্যের উপর। আমি সাধ্যানুসারে সেই ইস্যুগুলিকে জাতির সামনে তুলিয়া ধরিতে চেষ্টা করিয়াছি। কতদূর সফল হইয়াছি ‘স্পষ্টভাষী’ ও ‘মর্দে মু'মীন’-এর পাঠকগণই তাহা বলিতে পারেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ, পাট-এর কথাই বলি। প্রস্তাবিত জুট ইন্টারন্যাশনাল সম্পর্কে আট-নয় বছর আগে আমার গুরু যে-হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করিয়া গিয়াছেন (এবং যাহা লইয়া আমি এবং মােহাম্মদ আখতার-উল-আলমও অনেক লিখিয়াছি) কোন কোন মহলের একগুঁয়েমিতে সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক পাট সম্মেলনের (জেনিভা) ব্যর্থতা তাহারই নির্ভুলতা প্রমাণ করে। এরূপ আরও বহু দৃষ্টান্ত দেখানাে যাইতে পারে কিন্তু ভূমিকাকে দৃষ্টান্ত ভারাক্রান্ত না-করিয়া বক্ষ্যমান বিষয়সমূহের বিচারের ভার আমি আমার গুরুর এই মূল্যবান গ্রন্থের বিজ্ঞ পাঠকদেরই জন্য রাখিয়া দিলাম। আজ ৩০শে মে (৮১) আমাদের। ‘এক নিদারুণ জাতীয় শােকের দিন। আজ এই গ্রন্থের ভূমিকা লিখিতে বসিয়া আমার গুরুকেই বার বার মনে পড়িতেছে। ‘আহমদ পাবলিশিং হাউস' এই গ্রন্থ প্রকাশের দায়িত্ব গ্রহণ করিয়া জাতির যুগ সন্ধিক্ষণে একটি অমূল্য অবদানই রাখিয়াছেন। আমার জান্নাতবাসী গুরুর এই অমূল্য গ্রন্থ জাতিকে অনেক বিষয়ে সঠিক পথ-নির্দেশনা দান করিবে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। আহমদ পাবলিশিং হাউস-কে আমার শুভেচ্ছা ও মােবারকবাদ।
বিশিষ্ট লেখক, দেশভাগের সময়কালের খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ এবং শক্তিমান সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন বিচিত্র গুণের অধিকারী একজন মানুষ। আবুল মনসুর আহমদ এর বই সমূহ বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তিনি বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ব্যঙ্গাত্মক লেখকদেরও একজন। ‘আয়না’, ‘ফুড কনফারেন্স’, ‘গালিভারের সফরনামা’র মতো কালজয়ী ব্যঙ্গরচনাগুলো আবুল মনসুর আহমদ রচনাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইটি হলো তার সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রশংসিত বই। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত এ বইটি তার আত্মজীবনীমূলক রচনা। এছাড়াও ‘আত্মকথা’, ‘শেরে বাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু’- বইগুলোও স্মৃতিচারণমূলক। আবুল মনসুর আহমদ এর বই সমগ্রতে আরো আছে ‘সত্য মিথ্যা’, ‘জীবনক্ষুধা’, ‘আবে হায়াত’, ‘বাংলাদেশের কালচার’, ‘আসমানী পর্দা’, ‘বেশি দামে কেনা কম দামে বেচা আমাদের স্বাধীনতা’ ইত্যাদি। আবুল মনসুর আহমদের জন্ম ১৮৯৮ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা গ্রামে। ১৯১৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করার পর কলকাতার রিপন কলেজে ভর্তি হন আইন পড়বার জন্য। পড়ালেখা করার সময় খিলাফত এবং অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন তিনি। শিক্ষাজীবন শেষে ৯ বছর ময়মনসিংহে আইন ব্যবসা করেন। এরপর কলকাতায় গিয়ে সাংবাদিক জীবনের সূচনা করেন। ইত্তেহাদ, সুলতান, নাভায়ু, মোহাম্মদী, নবযুগসহ বেশ কিছু পত্রিকায় কাজ করেন তিনি। দেশভাগের কিছুকাল পূর্বেই ইত্তেহাদের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ দায়িত্বে থেকে তিনি মহান ভাষা আন্দোলনেও ভূমিকা পালন করেছেন। রাজনৈতিক জীবনে আবুল মনসুর আহমদ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অনুসারী ছিলেন। ১৯৪০ এর দশকে সক্রিয়ভাবে পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দেন। তিনি ১৯৫৪ এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীসভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে শিক্ষামন্ত্রী এবং বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। আইয়ুব সরকারের আমলে তিনি তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য কারারুদ্ধ হন। বাংলাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের অন্যতম এক প্রতিষ্ঠাতা তিনি।