একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন। ৩০ লক্ষ বাঙালির রক্ত আর ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। এ ঘটনা নিয়ে লেখা হচ্ছে অনেক গল্প, সাহিত্য, প্রবন্ধ, ইতিহাস। কিন্তু এর বাইরেও রয়েছে মানুষের অভিজ্ঞতার অপ্রকাশিত বয়ান। হাফিজুর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের অণুগল্প গ্রন্থটি সে-রকমই বয়ান। মোট দশটি অনবদ্য গল্প এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধোত্তর পরবর্তী সময় এ গল্পের পটভূমি। বাংলার পরিবারগুলো কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বীরাঙ্গনারা কিভাবে আজও সমাজের কাছে অসম্মানিত, সেই কাহিনিই বলা হয়েছে নানা ঘটনায়, নানাভাবে। লেখকের কলমে উঠে এসেছে হতভাগিনী নারীদের নানা কাহিনি, কখনো স্বর্ণালি, কখনো রাজিয়া, কখনো রোমেচা। কখনো মঞ্চে অভিনয়ের মধ্যেই এক বীরাঙ্গনার কান্না স্পর্শ করে দর্শকের মন। এইসব ঘটনাপ্রবাহ আবর্তিত যুদ্ধকে ঘিরে। বীরাঙ্গনাদের কাহিনি আজও কুয়াশায় ঘেরা। যে-কথা জানা হয়নি, লজ্জার ও অবহেলার আবরণে ঢাকা পড়ে গেছে, তাই বর্ণিত হয়েছে অত্যন্ত সরল ও খোলামেলা ভাষায়। ভাষাটি অন্তর্জালের। এটাই লেখার শক্তি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়— লেখাটা একটা লড়াই বিশেষ। লড়াই আছে লেখকের জীবনব্যাপী। লেখক নিজে একজন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। যুদ্ধের যাবতীয় সঙ্কটকে অনুভব করেছেন আত্মিকভাবেই। স্বভাবতই নারীজীবনের চরম অসম্মানগুলো তিনি হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছেন বলেই এত আন্তরিক ও খোলামেলা উচ্চারণ করতে পেরেছেন। যুদ্ধপরবর্তী দিনগুলোতে বীরাঙ্গনারা কোথায় হারালেন?— লেখকের বর্ণনায় কখনো যাত্রার মঞ্চে, কখনো বাড়ির পরিচারিকার বেশে, আবার একজন মুক্তিযোদ্ধার বাসরঘরে এঁদের দেখা গেছে। বাকি ক্ষেত্রে জুটেছে আরো লাঞ্ছনা, অপমান। যার ফলে মৃত্যু হয়েছে কতজনের। ভেঙে গেছে সুখস্বপ্ন। প্রতিটি গল্পই রচিত সমাজের নিচুতলার নিম্নবিত্ত মানুষকে নিয়ে। এ মানুষগুলো আমি, আপনি অথবা সবাই। ফলে মুক্তিযুদ্ধটি শেষ হয় না—নতুন করে শুরু হয় প্রতিদিনই। সেই অসমাপ্ত যুদ্ধের সৈনিক হিসেবে আমাদেরকে দাঁড় করায় এই গল্পপাঠ। জয়তী বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি কলকাতা, ভারত