বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে অন্যতম নাম বিষ্ণু দে। তাঁর প্রবন্ধ শুধু আবেগের উৎসার নয়; সেখানে যুক্তি, তথ্য ও তত্ত্বের নির্মোহ উপলব্ধির অনন্য বিন্যাস। বিষ্ণু দে-র প্রবন্ধের বিরুদ্ধে দুরূহতার ও দুর্বোধ্যতার অভিযোগ অনেকখানি কল্পিত বা প্রচলিত জনশ্রুতির ন্যায়। সমাজের রূপান্তরের সঙ্গে প্রবন্ধের বিষয়বস্তুর এবং শৈলীর যে রূপান্তর ঘটে তা বিষ্ণু দে-র অজানা ছিল না। তাঁর কবিতায় যেমন সমকাল স্পন্দিত, প্রবন্ধেও তেমনি মননময় কালের অভিঘাত দুর্লক্ষ্য নয়। তাঁর মনীষা যেহেতু প্রতিভা ও পাণ্ডিত্যের যোগফল' তাই 'রসরচনার স্বরূপ সম্বন্ধে অনর্জিত সংস্কার কাটিয়ে যাঁরা একবারও স্বকীয় সিদ্ধান্তে পৌঁছতে প্রয়াস পেয়েছেন তাঁদের আর বিন্দুমাত্র সংশয় থাকবে না' যে তাঁর প্রবন্ধ শুধু উপভোগ্যতায় উপাদেয় নয়; সেখানে আছে মনন, মেধা, , ঐতিহ্য, পরিশ্রমের ফসল। তাঁর ঐতিহ্য কেবল বাংলাদেশের নয়; তা বিশ্বমানবিক বলেই তাঁর প্রবন্ধে লোকায়ত জীবন থেকে আধুনিক বিশ্বের বিজ্ঞানমনস্কতা অনুপস্থিত নয়। তিনি তাঁর সৃষ্টির সন্ধানে আধুনিক সংস্কৃতির দিগ্বিদিকে বেড়িয়ে আসেন। আধুনিক জীবনের সংঘর্ষ আর ঘূর্ণাবর্ত, আত্মবিকাশ-জনিত দুরূহতা সত্ত্বেও জনসমাজের সামগ্রিক উত্তরণ প্রত্যক্ষই বিষ্ণু দে-র সাহিত্য-জীবনের কেন্দ্ৰীয় ভিত্তি। হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁকে যথার্থভাবেই বলেছেন, ‘আধুনিক ভারতীয় চৈতন্যের কর্ষণভূমির এক কর্মী'। সেই কর্মী- প্রাবন্ধিকের প্রবন্ধে আধুনিক জীবনের জটিলতা, সংকট আর উত্তরণ। তাঁর প্রবন্ধ না পড়লে কালের স্বরূপ অনুপলব্ধ থেকে যায়। খণ্ডিত চৈতন্য থেকে মুক্তির জন্য, সামাজিক অন্তর্দ্বন্দ্বের বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্তির জন্য, খণ্ডিত অসংলগ্ন বোধ থেকে উত্তরণের জন্য বিশ্বমনা বিষ্ণু দে-র প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সম্পদ।
বিষ্ণু দে (১৮ জুলাই ১৯০৯ - ৩ ডিসেম্বর ১৯৮২) একজন বিখ্যাত বাঙালি কবি লেখক এবং চলচ্চিত্র সমালোচক। তিনি ১৯৭১ সালে তাঁর স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ বইটির জন্য ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার জ্ঞানপীঠ লাভ করেন। বিষ্ণু দের পিতা অবিনাশ চন্দ্র দে ছিলেন একজন অ্যাটর্নি। বিষ্ণু দে কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউট এবং সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল-এ পড়াশোনা করেন । ১৯২৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর বঙ্গবাসী কলেজে আইএ পড়তে যান। ১৯৩২ সালে সাম্মানিক ইংরাজি বিষয়ে স্নাতক হন সেন্ট পল্স কলেজ থেকে। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজিতে এম এ করেন। ১৯৩৫ সালে তিনি রিপন কলেজে (অধুনা সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) যোগদান করেন শিক্ষক হিসেবে। এরপর তিনি ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি কলেজে এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি মৌলানা আজাদ কলেজে পড়ান। এরপর তিনি কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজেও অধ্যাপনার কাজ করেছেন। ১৯২৩ সালে কল্লোল পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে যে সাহিত্য আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল কবি বিষ্ণু দে তার একজন দিশারী। রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতায় তার অবদান বাংলা সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে। ১৯৩০ সালে কল্লোলের প্রকাশনা বন্ধ হলে তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের পরিচয় পত্রিকায় যোগদান করেন এবং সেখানে একজন সম্পাদক হিসাবে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। ১৯৪৮ সালে চঞ্চল কুমার চট্টোপাধ্যায়ের সহায়তায় তিনি সাহিত্য পত্র প্রকাশ করেন। তিনি নিরুক্তা নামের একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছিলেন। তার কবিতার মূল উপজীব্য হল মানুষ, তার সংগ্রাম ও রাজনীতি, সেখানে সমকালীন জীবনের, দেশ ও কালের, রাজনীতি ও সমাজের প্রতিধ্বনি। প্রথমদিকে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের দুই সংস্কৃতিরই প্রভাব পড়েছে তার লেখায়। দেশীয় পুরাণ, ইতিহাস, দর্শন, শিল্পসাহিত্য থেকে ইউরোপীয় ক্লাসিক ও আধুনিক শিল্প সাহিত্যের প্রভাব এবং পরে দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানের সময়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, তেভাগা-আন্দোলন ইত্যাদি থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পরের ঘটনাবহুল জীবন ও আন্দোলন তাঁর কবিতায় সরাসরি ছায়া ফেলেছে। তিনি বামপন্থী দর্শন দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। এছাড়া কবি টি এস এলিয়টের রচনাশৈলী এবং ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি ছড়ানো এই জীবন নামে একটি আত্মজীবনী লিখেছিলেন। এছাড়াও অনুবাদের কাজ করেছেন। তার অনুবাদ গ্রন্থের মধ্যে আছে এলিয়ট, পল অ্যালুয়ার ও মাও-ৎ-সেতুঙের কবিতা। বিষ্ণু দে'র সঙ্গে শিল্পকলা বিশেষজ্ঞ শাহেদ সোহরাওয়ার্দী ও শিল্পী যামিনী রায়ের বন্ধুত্ব ছিল। তিনি অঙ্কন শিল্পের উপর কিছু বই রচনা করেন, যেমন আর্ট অফ যামিনী রয়(সহযোগে) দ্য পেন্টিংস অফ রবীন্দ্রনাথ টেগোর (১৯৫৮) এবং ইন্ডিয়া অ্যান্ড মডার্ন আর্ট (১৯৫৯)। তিনি ক্যালকাটা গ্রুপ সেন্টার, সোভিয়েত ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশন, প্রগতি লেখক শিল্পী সংঘ, ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েসন, ভারতীয় গণনাট্য সংঘ প্রভৃতি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছবিও আঁকতেন। সাহিত্যে তাঁর অবদানের জন্য তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, নেহরু স্মৃতি পুরস্কার, এবং জ্ঞানপীঠ পুরস্কার লাভ করেছিলেন। এছাড়া তিনি সোভিয়েত ল্যান্ড অ্যাওয়ার্ড পান।