"বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও আমি" বইটির প্রথম ফ্ল্যাপ-এর লেখাঃ বড় বেদনা ছাড়া কি বড় কাজ হয়? বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের জর্নালে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ লিখেছিলেন, ‘কেন্দ্রের ভবনের ইটের দেয়ালগুলােকে আমরা কোনােদিন প্লাস্টার করব না। এই কেন্দ্র যে একদিন আমাদের রক্ত দিয়ে তৈরি হয়েছিল- এই ইটগুলাে তার সাক্ষী হয়ে থাক।' ইট তাে ক্ষয়ে যাবে, কিন্তু সুলিখিতভাবে ধরে রাখা গেলে একটি বড় স্বপ্ন ও সংগঠনের চলমান ইতিহাসটি টিকে যেতে পারে কালের আক্রমণ অগ্রাহ্য করে। সেই কাজটি নানাভাবেই করে যাচ্ছিলেন এ-সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ জর্নাল লিখে, সাক্ষাৎকার দিয়ে, নানা জায়গায় নানা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করে। এমনকি কেন্দ্রের পরিচিতিপত্র, ঘােষণাপত্রের মধ্যেও রয়ে গেছে এই কেন্দ্রটির প্রতিষ্ঠাপুরুষের স্বপ্ন ও ভাবনার বিবরণ। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র-সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কথা, লেখা, ভাবনা ও সক্রিয়তার সমাবেশ এই গ্রন্থ। একবার পড়তে শুরু করলে আর থামা যায় না। এই বইয়ে একই সঙ্গে পাওয়া যাবে অসাধারণ কথক ও বাগ্মীর বিস্তার করা সম্মােহনী জাল, একজন স্বপ্নবান মানুষের উদ্দীপনাসঞ্চারী চিন্তা, এক বেদনার্ত প্রেমিক-হৃদয়ের গােপন রক্তক্ষরণের বিবরণ। এই বইয়ের মূল্যবান সম্পদ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ-এর চমৎকার ভাষাশৈলী যা একই সঙ্গে মননশীল, ঋজু, প্রসাদগুণময় এবং হাস্যরসদীপ্ত! বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সম্পর্কে তাঁর ভেতর-বাহিরের পুরােটা বিবরণের জন্যে এই বই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু কেন্দ্র বিষয়ে অনুৎসাহিত পাঠকও বইটি পড়ে ঋদ্ধ হতে পারবেন জীবন, সময়, স্বদেশ ও জগৎ নিয়ে এই চিন্তাবিদের বিচিত্রগামী ভাবনার আলােয় আলােকিত হয়ে। এই বই একই সঙ্গে ব্যক্তিগত, সাংগঠনিক ও সর্বজনীন।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একইসাথে একজন খ্যাতিমান সাহিত্যিকও। আর সমাজ সংস্কারের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে জড়িয়ে থাকায় একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবেও পরিচয় লাভ করেছেন তিনি। এই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কলকাতার পার্ক সার্কাসে ১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস বাগেরহাট জেলার কামারগাতি গ্রাম। পাবনা জিলা স্কুল থেকে তিনি মাধ্যমিক এবং বাগেরহাটের প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার্থে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন এবং পরবর্তীতে এখান থেকেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনে একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। ঢাকা কলেজ, রাজশাহী কলেজসহ বিভিন্ন কলেজে তিনি অধ্যাপনা করেছেন। টেলিভিশনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনার মাধ্যমে টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। আর ষাটের দশকে বাংলাদেশে সাহিত্যের এক নতুন ধারা সৃষ্টির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে, এবং একইসাথে 'কণ্ঠস্বর' নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করে নতুন ঐ সাহিত্যযাত্রাকে করেছিলেন সংহত ও বেগবান। শুধু তা-ই নয়, দেশের মানুষের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলে তাদের মাঝে জ্ঞান ও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়ে তাদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ১৯৭৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন 'বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র', যা চল্লিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে কাজ করে যাচ্ছে এই লক্ষ্যে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর বই সমূহ এই ব্যাপারে বিশেষ অবদান রেখেছে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর বই সমগ্র এর মধ্যে 'ভাঙো দুর্দশার চক্র', 'আমার বোকা শৈশব', 'নদী ও চাষীর গল্প', 'ওড়াউড়ির দিন', 'অন্তরঙ্গ আলাপ', 'স্বপ্নের সমান বড়', 'উপদেশের কবিতা', 'অপ্রস্তুত কলাম' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সাহিত্য, শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি 'বাংলা একাডেমি পুরস্কার', 'একুশে পদক', 'র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার' ইত্যাদি সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।