ভূমিকা প্রীতিভাজন কমলেশ সেন 'গ্রাম বাংলার গল্প' নামক সম্পাদিত পুস্তকের ভূমিকা আমাকে কেন লিখতে অনুরোধ করলেন জানি না। আমি নিজে কয়েকটি ছোট গল্প লিখেছি। কিন্তু প্রগতিশীল সংস্কৃতি-আন্দোলনের প্রয়োজনে গল্প ও উপন্যাস রচনার প্রবল আগ্রহ পরিত্যাগ করে শেষপর্যন্ত অনবাদক ও প্রবন্ধকার হিসাবেই জীবন কাটালাম। অবশ্য প্রগতি সংস্কৃতি আন্দোলনের সংগঠক হিসাবে বাংলা সাহিত্যের গল্প ও উপন্যাস নিয়ে কিছু কিছু, প্রবন্ধ আমাকে লিখতে হয়েছে, বোধ করি সেই কথা ভেবেই আমাকে কমলেশের পছন্দ হয়েছে । ত্রিশ দশকে মাকস‘বাদী চিন্তাধারা যখন পংথিপত্র ও সংগঠনের মধ্য দিয়ে বাংলার তথা ভারতের সংস্কৃতিক্ষেত্রে প্রবেশ লাভ করে তখন সমস্ত ভারতীয় সমাজের চিত্রের মধ্যে গ্রামবাংলার চিত্র নতুন ও কিছু আগের পুরাতন সাহিত্যিকদের দৃষ্টিতে পরিবর্তন ঘটাতে চেষ্টা করে। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে তারাশঙ্কর গ্রামবাংলাকে যে-দৃষ্টিতে দেখে তাঁদের গ্রামবাংলাভিত্তিক রচনাগুলি লিখেছেন, তার সঙ্গে ত্রিশ-চল্লিশ দশকের দৃষ্টি- ভঙ্গীর মৌলিক পার্থক্য ছিল । লর্ড কর্ণওয়ালিশ প্রবর্তিত ভূমিব্যবস্থার সামাজিক- অর্থনৈতিক পরিবেশে লালিতপালিত হয়ে, হাবটি স্পেনসার, কোঁৎ-এর দার্শনিক ও নান্দনিক চিন্তাধারাপুষ্ট বুদ্ধি ও চিন্তাভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যে-সাহিত্য রচিত হয়েছিল তাতে অনেক ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদারনৈতিক মানবতাবাদ প্রকাশ পেলেও সেই সামাজিক সম্পর্ক'গালি প্রকাশ পায়নি, যার থেকে বলা যায় সাম্রাজ্যবাদী অন প্রবেশের ফলে গ্রামের সামাজিক সম্পর্কগুলির মধ্যে পরিবর্তন ঘটছে। গ্রাম থেকে শহরে কলকারখানায় এসে গ্রামের মানুষ বৈপ্লবিক শ্রেণী তৈরী করছে । গ্রামের কৃষক ও নিম্ন- মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে ঐক্য তৈরী হওয়ার বাস্তবতা সৃষ্টি হচ্ছে এবং গোটা ভারতে পংজিবাদ ও সামন্ততন্ত্রের ঐক্যের বিরদ্ধে শহর ও গ্রামের মেহনতী মানুষের ঐক্যবদ্ধতার শত— সমাবিষ্ট হচ্ছে। কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন চিত্র পাওয়া গেলেও তা সমগ্রের সঙ্গে তাৎপর্যহীন ৷ বাংলা নাটকের শরতে এই ছবির কিছ, আভাস পাওয়া যায় । মাইকেল মধ্যসন্দেনের ‘বড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ'তে সামন্ত হিন্দ, জমিদারের শঠতা ও দুশ্চরিত্রতার বিরুদ্ধে হানিফ ও গরীব ব্রাহ্মণের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা এবং দীনবন্ধ, মিত্রের নীলদর্পণে জমির উপর নির্ভরশীল মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে নবীনমাধবের সঙ্গে মুসলমান কৃষক তোরাপের একত্রে ক্ষেত্রমণিকে উদ্ধার এবং পরবর্তীকালে নীলকর সাহেবের বিরুদ্ধে নবীনমাধবের গ্রামে কৃষক সমাবেশের যে ইঙ্গিত রয়েছে তার কোনরূপ প্রতিচ্ছবি পরবর্তী লেখকদের রচনায় মেলেনি । শরৎচন্দ্রের মহেশ-এর মতো রচনা তাঁর নিজের লেখায় যেমন আর মেলে না, তেমনি তাঁর সমসাময়িক কালের গল্প-লেখকদের মধ্যেও পাওয়া যায় না । রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে গ্রামসমাজের কিছু ছবি উদার মানবিকতার রঙে রঙীন, কিন্তু সামাজিক গতিতত্ত্বের সন্ধান সেখানে কদাচিৎ মেলে ৷