"মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ" বইয়ের ফ্ল্যাপের অংশ থেকে নেয়া: বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে সমগ্র বাঙালী জাতির ত্যাগ, আত্মাহুতি ও স্বজন হারানাের করুণ কাহিনীর এক অনন্য ইতিহাস। ১৯৪৭ সালে দুই মেরুতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান ভেঙে চুরমার হয়ে যায়—যখন ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা—নিরস্ত্র, নিরীহ ও নির্যাতিত বাঙালি জাতির উপর আকস্মিকভাবে ঝাপিয়ে পড়ে এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে। শুরু হয় এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এই যুদ্ধের বৈশিষ্ট্য ছিল স্পষ্ট, জনসমর্থিত ও বহুমুখী ; একদিকে অত্যধিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও উন্নতমানের সমরাস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনী আর অন্যদিকে স্বল্প সংখ্যক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত মুক্তিবাহিনী। প্রতিপক্ষ যত শক্তিশালী হােক না কেন জয়ী আমাদের হতেই হবে, এর বিকল্প আমাদের ছিল না। আর জয়ী আমরা হবােই—এই ছিল আমাদের বিশ্বাস—এই ছিল আমাদের প্রত্যয়, কেননা এই যুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির অস্তিত্বের যুদ্ধ। গ্রন্থকার এই চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে একজন সাহসী সৈনিকের মতাে যেমন যুদ্ধে নেমেছেন প্রতিপক্ষকে পরাজয়ের দৃপ্ত শপথ নিয়ে ; তেমনি এ-গ্রন্থ লিখতে গিয়ে একজন সৈনিকের মতাে সাহস ও নিষ্ঠার পরিচয় গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে ফুটিয়ে তুলেছেন। মেজর জেনারেল কে.এম. সফিউল্লাহ মুক্তিযুদ্ধকালে ছিলেন একজন প্রজ্ঞাবান মেজর, তিনি তাঁর নামের আদ্যক্ষর দিয়ে এস ফোর্স' নামে একটি নিয়মিত ব্রিগেড গঠন করে সে ব্রিগেড নিয়ে অসিম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন। তাঁর কমান্ডে পরিচালিত বিভিন্ন যুদ্ধের বর্ণনা ছাড়াও অন্যান্য সেক্টরে পরিচালিত রণাঙ্গণসমূহের প্রাণবন্ত বিবরণ প্রাঞ্জল ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন গ্রন্থকার। স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনৈতিক চিত্রের চেয়ে হযুদ্ধের চিত্র নিয়ে সাধারণ জনগণের অধিকতর আগ্রহকে লেখক মূল্য দিয়েছেন বেশি। বঞ্চিত সাধারণ মানুষের দুর্দশার উল্লেখসহ সামরিক বাহিনীতে প্রচলিত বৈষম্যের চিত্র গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে উদ্বেগ, অস্থিরতা, অনিশ্চিয়তা এবং বিজয় মুহূর্তের হৃদয়গ্রাহী আলেখ্য সন্নিবিষ্ট হয়েছে, সেই সাথে তুলে ধরা হয়েছে পাকিস্তান বাহিনীর বীভৎস অত্যাচারের চিত্র। গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রের নানান দুর্লভ রেখাচিত্র, যা শুধু সচেতন পাঠককে অনুসন্ধিৎসু-ই করবে না, গবেষকদের জন্যও হবে একটি অন্যতম বিষয়। গ্রন্থকার স্বয়ং সত্য এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন এবং সীমাহীন বিপত্তি সত্ত্বেও কীভাবে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জিত হয়েছে সে সবের প্রাণবন্ত বর্ণনায় পাঠক হৃদয়স্পর্শী অনুভূতিতে অবিভূত হবেন। গ্রন্থে উপস্থাপিত নানান অজানা অধ্যায় সাহসী উচ্চারণে উন্মােচিত করেছেন গ্রন্থকার এতে করে পাঠক প্রতিটি পরিচ্ছেদে শিহরণ, উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ, আনন্দ এবং উচ্ছাসিতাভিজ্ঞতায় ভাবাবিষ্ট হয়ে স্বয়ং এক সময় নিজের অজান্তেই যুদ্ধে জড়িয়ে গেছেন বলে আশ্চর্যানুভূতিতে উদ্বেলিত হয়ে উঠবেন।
মেজর জেনারেল কে, এম, সফিউল্লাহ, বীর উত্তম সেপ্টেম্বর ১৯৩৫ সনে তদানিন্তন ঢাকা জেলার (বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলা) রূপগঞ্জ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৩ সনে পাকিস্তান সেনা বাহিনীতে যােগদান করেন এবং ১৯৫৫ সনে পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমি থেকে গ্রেজুয়েশন করে সেকেন্ড লেফটেনেন্ট পদে নিযুক্ত হন। সেনা বাহিনীতে কমিশন প্রাপ্তির পর ১৯৭০ সন পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে, স্টাফে এবং প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে দক্ষতার সাথে কাজ করেছেন। তিনি ১৯৬৮ সনে পাকিস্তান কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজ কোয়েটা থেকে পিএসসি লাভ করেন। '৭১-এর স্বাধীনতার আন্দোলনকে সমর্থন করে জেনারেল সফিউল্লাহ ২৮ মার্চ '৭১ -এ দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সেকেন্ড ইন কমান্ড থাকাকালে ঐ ব্যাটালিয়ন নিয়ে বিদ্রোহ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে মেজর সফিউল্লাহ তিনি তাঁর নামের প্রথম অক্ষর ‘এস' দিয়ে এস ফোর্স' নামে একটি নিয়মিত ব্রিগেড গঠন করেন এবং সে ব্রিগেডের কমান্ডার নিযুক্ত হন। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি জীবন বাজি রেখে কখন কখন সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। ১৬ ডিসেম্বর '৭১-এর বিজয় দিবসে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণকালে তিনি তার এই ব্রিগেড নিয়ে ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান ও সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে গ্যালেন্টি এওয়ার্ড বীর উত্তম পদকে ভূষিত করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার এপ্রিল ১৯৭২ সনে তাকে প্রথম সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়ােগ করেন। এই পদে তিনি আগষ্ট '৭৫ পর্যন্ত নিয়ােজিত ছিলেন। | জেনারেল সফিউল্লাহ ১৯৭৫-এর পর থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত এক নাগারে ১৬ বৎসর বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ১৯৭৬-এ মালয়শিয়া ও ১৯৮১-তে কানাডায় হাইকমিশনার, ১৯৮৬-তে সুইডেনে এ্যাম্বাসেডর এবং ১৯৮৭ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে হাইকমিশনার হিসেবে কর্তব্য পালন করেছেন। তিনি ১৯৯২ সনে সরকারি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। জেনারেল সফিউল্লাহ এক ছেলে এবং তিন মেয়ের পিতা। তিনি সৌখিন ফটোগ্রাফার এবং নিজ হাতে বাগান করতে পছন্দ করেন। খেলাধুলার মধ্যে বর্তমানে তিনি গলফ খেলেন এবং অবসর সময়ে লিখেন।