ভূমিকা সেই ছোটবেলা থেকেই যখন বাবা-মার পাশে বসে পড়ালেখা করতে করতে রাত আটটায় বিটিভির সংবাদ একটুআধটু দেখতাম, তখন থেকেই একধরনের খবর নিয়মিতই চোখে পড়ত। কেমন ছিল সেই খবর? খবরের সারকথা ছিল আজ ফিলিস্তিনের অমুক জায়গায় ইসরায়েলি বাহিনী হামলা চালাচ্ছে, তো কাল তাদের হামলায় এতজন নিরীহ ফিলিস্তিনি মারা যাচ্ছে, পরশু আবার আরেক কাহিনি…। দেখতাম আহত ফিলিস্তিনিরা চিৎকার করছে, স্বজন হারানোর বেদনায় বুক চাপড়ে কান্নাকাটি করছে, ধ্বংসস্তূপের পাশে হতবিহবল অবস্থায় ধূলোময়লা মেখে দাঁড়িয়ে আছে কেউ না কেউ। মানবজাতির ইতিহাস কিংবা বৈশ্বিক রাজনীতির জটিল বিষয়াদি বোঝার মতো বয়স তখনও হয়নি। তবে যে প্রশ্ন মাথায় খুব বেশি ঘোরাফেরা করত, তা ছিল অনেকটা এরকম- “আচ্ছা, এই ফিলিস্তিন আর ইসরায়েলের মাঝে কী হয়েছে? ফিলিস্তিনিরা এভাবে মার খায় কেন?” দেখতে দেখতে বয়স বেড়েছে, বেড়েছে জানাশোনার পরিধি। আমার জীবনের অনেক প্রেক্ষাপট বদলে গেলেও বদলায়নি ফিলিস্তিনের দুর্ভাগা সেই মানুষগুলোর জীবনের গল্প। ফিলিস্তিনিরা আজও মার খায়, নির্যাতিত হয় ইসরায়েলিদের হাতে, বিনা অপরাধে হারায় সাধের জীবন, খুন হতে দেখে প্রিয়জনকে, সাথে খুন হয় বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল স্বপ্নগুলোকেও। ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল সংক্রান্ত বিভিন্ন বই পড়েছি বাংলা ভাষায়; সেখানে ইতিহাস ছিল, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল, তবে আমার মন যা খুঁজছিল তা কোথাও খুঁজে পাইনি। সে খুঁজে চলেছিল এমন কিছু কঘটনা, যেখানে ফিলিস্তিনিদের ইতিহাস নয়, বরং একজন ফিলিস্তিনির কাহিনি থাকবে, থাকবে তার জীবনযুদ্ধের গল্প। যে যুদ্ধে সে এখনও লড়ে যাচ্ছে, প্রতিনিয়ত মার খাচ্ছে, তার স্বপ্নগুলো আহত-নিহত হচ্ছে, প্রিয়জনেরা আশ্রয় খুঁজে নিচ্ছে ছবির ফ্রেমে, সহায়-সম্বল সব চোখের সামনেই হাতবদল হয়ে যাচ্ছে, তবুও তারা হাল ছাড়ছে না; প্রচণ্ড চাপে হয়তো নুয়ে পড়ছে, তবু ভেঙে পড়ছে না। এই সংক্রান্ত ঘাঁটাঘাঁটি থেকেই একদিন হাতে এলো ‘প্যালেস্টাইন স্পিকস’ বইটি, যেখানে উঠে এসেছে আমার এতদিন ধরে খুঁজে চলা কাহিনিগুলোই। একেকজন ফিলিস্তিনি জীবনের একেক ক্ষেত্র থেকে উঠে আসা, পরিবারে একেকরকম দায়িত্ব পালন করছে, তবু তাদের সবার প্রতিপক্ষ এক, কষ্টের উৎস এক, শুধু সেসব কষ্টের রঙ আলাদা। সেখানে নিজের বোনদের অত্যাচারিত, সম্ভ্রমহানি হতে দেখে, সন্তানহারা মায়ের বুক চাপড়ানো আর্তনাদ শুনে, বছরের পর বছর বিনা বিচারে জেলে কাটানো বন্দীর উপর নির্যাতনের বর্ণনা তাদের নিজেদের মুখেই শুনে বারবার শিউরে উঠেছি, কখন যে চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করেছে টের পাইনি। একসময় বুঝতে পারি, এই বইতে উঠে আসা সত্য ঘটনাগুলো বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদেরও জানা দরকার, বোঝা দরকার ফিলিস্তিনের মানুষগুলো আসলেই কতটা কষ্টে দিন কাটাচ্ছে তার প্রকৃত চিত্র। সেই লক্ষ্যেই এই বইয়ের ভাষান্তরের কাজে হাত দিই। আলহামদুলিল্লাহ্, সুস্থ দেহে শেষও করতে পারলাম এর কাজ, যার মধ্য দিয়ে আলোর মুখ দেখল ‘ওয়ার ডায়েরি সিরিজ’ এর তৃতীয় বই ‘ফিলিস্তিনের আর্তনাদ, ফিলিস্তিনিদের আর্তনাদ’। আল্লাহ্র কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করতে হবে এজন্য যে আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলার সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করে যখন এই সিরিজের প্রথম বই ‘সাচিকো : অ্যা নাগাসাকি বম্ব সারভাইভার্স স্টোরি’ অমর একুশে গ্রন্থমেলায় আসে, তখন একবারের জন্যও ভাবিনি যে এখান থেকে একটি সিরিজের জন্ম হবে। এরপর হাত দিই ‘আইসিসের কবলে দিনগুলি’ বইয়ের কাজে, যেখানে ইসলামিক স্টেটের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে জীবন সংগ্রামে লিপ্ত সিরিয়ার রাক্বা শহরের এক যুবকের সত্য কাহিনি উঠে এসেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে বইটি প্রকাশের পূর্বেই বুঝে যাই, এই বইগুলো আসলে একই বার্তা দিচ্ছে- যুদ্ধাহতদের দিনলিপি। সেখান থেকেই যাত্রা শুরু করে এই ‘ওয়ার ডায়েরি সিরিজ’। বিশেষ ধন্যবাদ দিতে চাই ‘স্বরে অ’-এর প্রকাশক রাজু ভাইকে, যিনি এই সিরিজ এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে প্রতিনিয়ত আমাকে উৎসাহ দিয়ে চলেছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন এর মানোন্নয়নের ব্যাপারে, দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন পরবর্তী বইগুলোর ব্যাপারেও যা এই সিরিজ ছাড়িয়ে আরও অনেক অনেক দূর বিস্তৃত। ধন্যবাদ দিতে হবে বর্তমান সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক রাজনীতি বিশ্লেষক মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহা ভাইকেও, যিনি ভাষান্তর চলাকালে বিভিন্ন বিষয় বোঝানোর জন্য সুদূর লিবিয়া থেকে অনলাইনে এই অধমের পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করেছেন। আমার ছোট বোনের কথা না বললেই নয়, যে নিয়মিত লেখাগুলোর বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে পরামর্শ দিচ্ছিল। সেই সাথে প্রতিনিয়ত প্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছিল আমার সহধর্মিণীও, যেন সময়মতো কাজ গুছিয়ে আনতে পারি, পাঠকদের হাতে ভাল কিছু তুলে দিতে পারি। আশা করি প্রকাশিত বইটি তাদের সেই পরিশ্রম ও প্রত্যাশাকে কিছুটা হলেও সম্মানিত করতে পারবে। শেষাংশে কেবল একটা কথাই বলব- দুর্ভাগা ফিলিস্তিনিদের জীবনে আবারও সৌভাগ্যের সূর্য উদিত হোক, প্রতিষ্ঠিত হোক তাদের ন্যায্য অধিকার, নিশ্চিত হোক অন্যায়ভাবে তাদের অধিকার হরণকারীদের উপযুক্ত শাস্তি- আল্লাহ্র কাছে এই দোয়াই করব আজীবন। নিজে ভাল বই পড়ুন, অপরকে ভাল বই পড়তে উৎসাহিত করুন। আল্লাহ হাফেজ। মুহাইমিনুল ইসলাম অন্তিক মার্চ ২০২১