জলই মানুষের প্রাণ। জলকে ঘিরে একসময় সভ্যতার সৃষ্টি হয়েছিলো। এই জলের তলায় অনেক সভ্যতার সমাধিও ঘটেছে। অসংখ্য গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে এল ডোরাডো, আটলান্টিস, লেমুরিয়া, শাম্বালা, মু’র মতো বহু নগরসভ্যতা আসলে রূপকথার কাহিনী নয়। আমাজন অরণ্যের গভীরে কিংবা আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে হয়তো আজও এসব নগরী ঘুমিয়ে আছে। একদা এই বিপুলা বারিধির বুকে চন্দ্রদ্বীপ নামের রাজ্যটি জেগে উঠেছিল। জলের অতলে জ্বলে ওঠা এক দ্বীপ শিখা ছিল চন্দ্রদ্বীপ। এই রাজ্যকে নিয়েও আমাদের দেশের দক্ষিণাঞ্চলে অনেক লোককথা ছড়িয়ে আছে। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যেরই ঐতিহ্যসমৃদ্ধ জনপদ বাকেরগঞ্জের একটি গ্রাম শিবপুর। সর্বশেষ ইংরেজ আমলের সরকারি নথিপত্রে শিবপুরকে একটি পরগণা হিসেবে এর পরিচয় পাওয়া গেলেও এখন তা বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার একটি গ্রাম। মধ্যযুগে এ অঞ্চল ছিল চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের রাজধানী। মোঘল আমলের শুরুর দিকে তা ‘বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ’ বা সরকার বাকলা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। আঠার শ’শতকে সেলিমাবাদের দশটি পরগণার একটি ছোট পরগণা ছিল শিবপুর। পরে এটি বুজর্গউমেদপুর পরগনার অন্তর্ভুক্ত হয়। শিবপুরের অবস্থান, বর্তমান বাকেরগঞ্জের কিছুটা দক্ষিণ-পশ্চিমে, শ্রীমন্ত নদীর তীরে। শিবপুরের সুনাম এক সময় বাকেরগঞ্জ ছাড়িয়ে বহুদূর ছড়িয়ে পরেছিল। এর কিছুটা হয়েছিল ধর্ম প্রচার বা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এখানে স্থায়ীভাবে বসতিস্থাপনকারী অনেক বুজুর্গ ব্যক্তিদের কারণে। সপ্তদশ শতকের শুরু থেকে শিবপুর গ্রামের নাম বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এ সময় সেখানে মহম্মদ তক্কী নামের একজন মুসলমান ধমর্ প্রচারকের আগমন ঘটে। ইংরেজদের সময় খৃস্টান পাদ্রিরাও গ্রামটি বেছে নিয়েছিল ধর্ম প্রচার কাজে অনুকূল একটি স্থান বলে। তখন এটি পাদ্রি শিবপুর নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। সব মিলিয়ে পাদ্রি শিবপুর এখন সব ধর্মাবলম্বীর মানুষের কাছে একটি অসাম্প্রদায়িক তীর্থ। একই সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের অংশ। সেই ইতিহাস লুকিয়ে আছে এখানকার কিছু ইটের ধ্বংসস্থপ ও ধুষর হয়ে পড়া অনেক ঐতিহ্যের মাঝে। এখনও স্থানীয় জনগণের দৈনন্দিন ব্যবহার্য তৈজসপত্র, আসবাব, পোশাক-পরিচ্ছেদ কিছুটা হলেও অতীত সমৃদ্ধির কথা মনে করিয়ে দেয়। অথচ ইতিহাস হলো ‘জীবনের শিক্ষক’। জ্ঞানকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যম হলো ইতিহাস। নিজের অতীত এবং পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে জানার যে চিরন্তন আকাঙ্খা মানুষের, ইতিহাস তা পুরণ করে। তা মানুষকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ভাবতে শেখায়, শিক্ষা নিতে শেখায়। তার অতীতকে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করে। সৃষ্টির ক্রমবিকাশের ধারায় জীবনের অগ্রগতি। বইটিতে প্রাচীনকাল থেকে ধারাবাহিকভাবে শিবপুর এবং ও এ অঞ্চলের নানা আর্থ-সামজিক বিবর্তনের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। তথ্যভিত্তিক ইতিহাস পর্যালোচনার পাশাপাশি বিভিন্ন লোককথা, কিংবদন্তী, প্রচলিত কাহিনী, শ্রুতিকথাও স্থান পেয়েছে এখানে। এর মাধ্যমে ইতিহাসের লুপ্তধারাটি অনুসন্ধান করা হয়েছে।
Title
চন্দ্রদ্বীপ : দক্ষিণ বঙ্গের লুপ্ত সভ্যতার উপাখ্যান
এন. এস. নওরোজ জাহান জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৯ নভেম্বর, বাকেরগঞ্জ জেলার পারশিবপুর গ্রামে; মাতুলালয়ে। পিতা মরহুম ডাঃ এসকান্দার আলী ও মাতা মরহুমা জোবায়দা আলী। তিনি ৮০-র দশকে সানবীম নার্সারি এন্ড মিহল স্কুলের প্রিন্সিপাল ছিলেন। পুষ্পপ্রেমিক লেখিকা পেশায় সাংবাদিক। ষাট দশক থেকেই লেখালেখি করেন। তিনি পটুয়াখালী জেলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নারী জাগরণের পথিকৃত। তিনি পটুয়াখালী নাট্যজগতের প্রথম মহিলা নাট্যশিল্পী । তিনি লায়ন্স ইন্টারন্যাশনাল ঢাকা জেলা ৩১৫ এ’র ডাইরেক্টর ও কো-চেয়ারম্যান ও বনানী লিও ক্লাবের স্পন্সর ছিলেন। নওরোজ জাহান বাংলা একাডেমী ও এশিয়াটিক সোসাইটির জীবন সদস্য ও সাব এডিটর কাউন্সিলের নির্বাহী সদস্য। তাঁর প্রথম লেখা 'রক্তে লেখা একুশে ফেব্রুয়ারী (১৯৬৭) প্রকাশিত হয় বরিশালের মাসিক খাদেম-এ। নওরোজ জাহানের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ 'ফুলের জলসায় (১৯৯৬)। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইট থেকে প্রকাশিত হয়েছে A Field Guide to Bangladeshi Flower (২০০৫)। নওরোজ জাহানের স্বামী এম. এ. মজিদ মিয়া, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তাঁর দুই সন্তান, কন্যা যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস এ এন্ড এম ইউনিভার্সিটির স্নাতক ফারাহ সাদধা মজিদ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নোকিয়ার ইঞ্জিনিয়ার ও ছেলে যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক প্রকৌশলী তানভীর এহ্সান তারিক বর্তমানে মটরোলা'র ইঞ্জিনিয়ার।