১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজউদদৌলার পরাজয় ও হত্যার মধ্য দিয়ে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সূচনা হয়। ইংরেজরা প্রথমে বাংলায় ও পরে সমগ্র ভারতবর্ষে তাঁদের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ১৭৬১ সালে ইংরেজরা কৌশলে অধিকার করে নেয় প্রাচীন সমৃদ্ধশালী বন্দর শহর চট্টগ্রাম। তারপর থেকে ভারতবাসী ইংরেজ কোম্পানির দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সােচ্চার হয় ও দীর্ঘমেয়াদী শােষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে বহুবার-বহুভাবে মুক্তির পথ খোঁজার চেষ্টা করে। ১৮৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে দেশীয় পদাতিক বাহিনীর সিপাইরা প্রথমে অবিভক্ত বাংলার বহরমপুর ও ব্যারাকপুরে বিচ্ছিন্নভাবে হলেও বিদ্রোহ করে। সে বিদ্রোহ ও বিদ্রোহীদের প্রতি নির্মম শাস্তির খবর ছড়িয়ে পড়ে ভারতবর্ষের আনাচে কানাচে। চট্টগ্রাম ও ঢাকায় অবস্থানকারী সেনারাও যথাসময়ে সে খবর জানতে পারে। কিন্তু ইংরেজ কোম্পানির অতি সতর্ক ভূমিকার কারণে সেখানে সে সময় কোনাে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেনি। এর নয় মাস পর সংঘঠিতভাবে ও অতি ব্যাপকভাবে সিপাইরা বিদ্রোহ করে প্রথমে চট্টগ্রামে ও পরে ঢাকায়। অস্ত্রাগার ও সরকারি কোষাগার ভেঙে অস্ত্র ও অর্থ লুট করে, কারাগারের তালা ভেঙে কয়েদিদের ছেড়ে দেয় ও ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। শহর ছেড়ে পালায় দুর্বিনীত ইংরেজ। শােনা যায় কর্ণফুলী নদীতে নােঙরকৃত হালিশহরের আবদুল মালুমের সরের জাহাজে চড়ে গভীর সমুদ্রে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। কিছু কমবেশি চারশ বিদ্রোহী সিপাই তাঁদের পরিবার-পরিজন নিয়ে চট্টগ্রাম ছেড়ে যায়। চট্টগ্রামের লােককবির মতে ‘তেরজুরি মারি যারগৈ রঙবাত্তি জ্বালাই’ । সিপাইরা ত্রিপুরা হয়ে চলে যায় আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ, কাছাড় ও জৈন্তিয়ামনিপুর অঞ্চলে। চার মাসের দীর্ঘ পদযাত্রা, যুদ্ধ, অনাহারঅর্ধাহার ও রােগজীর্ণ সিপাহিদের জীবনে নেমে আসে নির্মম পরিণতি। আসামের লােকগীতিকায় তার মর্মস্পর্শী বিবরণ পাওয়া যায়। এর ৭৩ বছর পর চট্টলবীর সর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা অস্ত্রাগারসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আক্রমণ-চালায় ও দখল করে নেয়। চারদিনের জন্য মুক্ত হয় চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের যুবকতরুণদের এই সশস্ত্র অভ্যুত্থানে সংখ্যাগুরু মুসলিমদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এছাড়া মেয়েদেরও ছিল গৌরবময় ভূমিকা। গ্রন্থে সেসব কাহিনি তথ্যউপাত্ত সহকারে তুলে ধরা হয়েছে। আশা করা যায় চট্টগ্রামের ইতিহাস ও ভারতের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচনায় বইটি বিশেষভাবে কাজে আসবে।