ঝড়ের তাণ্ডবে সারারাত এক মুহূর্তের জন্যও ঘুম এলো না। ঘুম আসবেই বা কীভাবে? সরু এক বরফের রিজে বরফ কেটে একটি তাঁবুর জায়গা করে সেখানেই তাঁবু লাগানো হয়েছে। এর মধ্যে একপাশের নিচে কার্নিশ। নড়বড়ে এক জায়গা। যেকোন মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে। দুপুরের পর থেকেই প্রচণ্ড তুষার ঝড়। থামার কোন লক্ষণ নাই। তাঁবুর ভিতরে আমরা চারজন। ড্যান্ডি শেরপা, ঠুন্ডু শেরপা, মুহিত ভাই ও আমি। তাঁবুর ভিতরেই বরফ গলিয়ে গরম এক মগ স্যুপ খেয়ে স্লিপিং ব্যাগের ভিতরে শুয়ে আছি। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে ৩০ ডিগ্রি। ঘণ্টায় প্রায় ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার গতিবেগে তুষার ঝড়। মনে হচ্ছে আমাদের সহ তাঁবু উড়িয়ে নেবে। ঝড় থামছেই না। প্রতিমুহূর্ত রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় কাটছে। এই বুঝি তাঁবু উড়ে গেল। এতো তুষার ঝড় হচ্ছে, তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে মাইনাস ৩৫। তখন একবারের জন্যও মনে হয়নি সামনে আমার জন্য কতটা ভয়ংকর সময় আসছে। আমি পারবো না বা ফিরে আসবো কি আসবো না। শুধু একটাই লক্ষ্য আমাকে চ‚ড়ায় যেতে হবে। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য যেতে হবে। হাতের আঙুল, নাক ও ঠোঁট ঠাণ্ডায় অসাড় হয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ, মনে হচ্ছিল একটু পানি পেলে হয়তো বেঁচে যাবো। ড্যান্ডিকে বললাম আমার পানি খেতে হবে। আমাকে আমার ব্যাগ থেকে পানি বের করে দাও। আমি আর এগোতে পারছি না। ড্যান্ডি জানালো এই ঝড়ের মধ্যে সময় নষ্ট করা যাবে না। যেভাবেই হোক আমাদের তাড়াতাড়ি চূড়ায় উঠতে হবে এবং নেমে আসতে হবে। নাহলে আমরা দু’জনই মারা যাবো। তিনদিন ধরে কোন ভারী খাবার খাইনা, শুধুমাত্র চা, স্যুপ আর চকলেট। শরীরের কোন শক্তি নেই, মনের জোরেই এগিয়ে চলছি। গলা এমন ভাবে শুকিয়ে গেছে যে চেষ্টা করেও কথা বলতে পারছি না। ড্যান্ডি বারবার বলছিল, ‘শাকিল চেষ্টা করো, তাড়াতাড়ি করে নিচে যাওয়ার। আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করেছে। চারাপাশ মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। এখানে দেরি হলে আমাদের দুই জনকেই মরতে হবে। ফিরে যাওয়ার সম্ভব হবে না।’ ঝড়ের গতি বেড়েই চলছে। বাতাসের সাথে বরফ উড়ে এসে গায়ে লাগছে। আমি ড্যান্ডিকে কান্না জড়ানো গলায় বললাম, ‘ড্যান্ডি দাই (ভাই), প্লিজ আমার ব্যাগ থেকে ফ্লাক্সটা বের করে আমাকে একটু পানি দাও। নয়তো আমি আর নিচে নামতে পারবো না। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।' ড্যান্ডি বারবার বলছিল চলো এই রিজ থেকে নেমেই আমরা পানি ও চকোলেট খাবো। আমি আর পারছিলাম না। তাই ড্যান্ডিকে বললাম, আমাকে যদি বাঁচাতে চাও তাহলে পানি দাও।
পর্বতারোহী ইকরামুল হাসান শাকিল বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ পর্বতারোহণ ক্লাব ‘বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং এন্ড ট্রেকিং ক্লাব’ এর সদস্য। তিনি ২০১৪ সালে ভারতের উত্তরকাশীতে অবস্থিত ভারতের সেনাবাহিনী পরিচালিত প্রতিষ্ঠান নেহরু ইনস্টিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং থেকে পর্বতারোহণের মৌলিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং ২০১৮ সালে একই প্রতিষ্ঠান থেকে পর্বতারোহণের উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। উল্লেখযোগ্য অভিযান: ২০১৩: কোলকাতা থেকে ঢাকা সলো ট্রেকিং। ২০১৫: মাউন্ট কেয়াজো-রি (সামিট, ২০ হাজার ২৯৫ ফুট), নেপাল। ২০১৭: লারকে পিক (২০ হাজার ৫০২ ফুট), নেপাল। ২০১৭: মানাসলু সার্কিট ও লারকে পাস অতিক্রম (১৬ হাজার ৭৫২ ফুট), নেপাল। ২০১৮: দ্রৌপদি-কা-ডান্ডা-২ (সামিট, ১৮ হাজার ৭১১ ফুট), ভারত। ২০১৯: হিমলুং হিমাল (সামিট, ২৩ হাজার ৩৮০ ফুট), নেপাল। প্রকাশিত বই: ২০১১: হেয়ালী ফেরা ২০১৬: মাউন্ট কেয়াজো-রি শিখরে বাংলাদেশ ২০১৮: পদচিহ্ন এঁকে যাই ২০১৯: পর্বতাভিযানে শ্বাসরুদ্ধকর পনেরো ঘণ্টা নাটক: ২০২০: নুরু মিয়ার কিচ্ছা (পথনাটক, মঞ্চায়নে: পদাতিক নাট্য সংসদ বাংলাদেশ)